বাংলাসাহিত্যে এ পর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক, লেখক এবং সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সাহসী, বুদ্ধিমান, কুশলী, বহুমুখী এবং তেজদীপ্ত লেখকদের তালিকায় একটি নাম জ্বলজ্বল করবে, নামটি-আহমদ ছফা। মননশীল এবং সত্যসমৃদ্ধ স্পষ্টবাদী সাহিত্যিক আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ-প্রগতিপন্থী একজন গণবুদ্ধিজীবী। নতুন নতুন বিষয় অনুসন্ধান করা তার সাহিত্যের প্রকৃতিজাত স্বভাব। তার উপন্যাসের ভেতর দিয়ে তিনি মানুষের জীবনের-মনস্তত্ত্বের ভালো-খারাপ নানান বিষয়ের আলোকপাত করেছেন খুবই সহজ-সরল ভাষায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, জাতির দর্পণ হিশেবে আহমদ ছফাকে অভিহিত করা হয়। তিনি ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। সলিমুল্লাহ খানের মতে ছফা কৃষকের লেখক, মাটির লেখক, মুক্তিযুদ্ধের লেখক। অনেকেই আহমদ ছফাকে প্রাবন্ধিক হিশেবে দেখেন, প্রকৃতবিচারে ছফা হলেন বহুমাত্রিক অত্যন্ত শক্তিধর একজন প্রতিভাবান লেখক। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট। তার লেখায় বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। আহমদ ছফা যুবক বয়সে প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তবে তার কলম নির্দিষ্ট কোন দলের পক্ষে ছিল না। ক্ষুরধার লেখনির কারণে তার কলম অনেকের কাছেই ছিল খুব অস্বস্তিকর। এক কথায় তিনি তার কলমকে ভয়ানক এক অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। বলা হতো, তার মসি ছিল অসির চেয়েও ভয়ংকর রকমের ধারালো। যে সত্য প্রকাশ করতে তার সমকালীন বা বর্তমানেও অনেকে হিমশিম খেতেন বা খান, তিনি সেটা অসঙ্কোচভাবে অবলীলায় প্রকাশ করতেন। আহমদ ছফা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন প্রগতিশীল লেখক। অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সর্বদাই তার কলম ছিল ক্ষুরধার। অনেকের মতে, বাংলাদেশে আহমদ ছফার মতো সাহসী লেখক দ্বিতীয়টি নেই। কখনো হিশেব করে লিখতেন না ছফা। অত্যন্ত রাগী ছিলেন, কখনো কারো কাছে আপোষ করেননি। তাই বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে আহমদ ছফা একজনই। কেউ যদি কয়েক পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ পড়ে কোনো বিষয়ে নিবিড় জ্ঞান অর্জন করতে চায়, তাহলে তার জন্য সহজ ও বিচক্ষণ উপায় হচ্ছে আহমদ ছফা পাঠ। যে পাঠক ছফা পড়েননি, তিনি বাংলা সাহিত্যের অমৃতের স্বাদ গ্রহণ করেছেন বলা যাবে না।
মানবিক মূল্যবোধ আর গুণাবলির জন্যও আহমদ ছফা ছিলেন অনন্য। আহমদ ছফা অনেকের জীবনের নানা সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েছেন, বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সহযোগিতার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। বাংলার নামকরা চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আহমদ ছফা। দু’জনেই ছিলেন বোহেমিয়ান বা ভবঘুরে, অবিবাহিত এবং খ্যাতি, ধনসম্পদ বা অন্যান্য বৈষয়িক মোহবিবর্জিত। প্রথম দিকে তরুণ চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানকে কেউ পাত্তা দিতেন না। সুলতানকে মূল্যায়ন করা দূরে থাক, অনেক সময় অপমানিতই হতে হয়েছে। ছফা সব সময়ই তার বন্ধুকে সাহস, অনুপ্রেরণা ও প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দিতেন। দৈনিক ইত্তেফাকের তখনের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তান, ড. হোসনে জিল্লুর রহমানদের সহায়তায় ঢাকার কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। আহমদ ছফা সুলতানের ব্যক্তিত্ব, চিন্তাশক্তি ও চিত্রকর্মের উচ্চ প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মূলত তারপরেই এসএম সুলতান সবার দৃষ্টিতে চলে আসেন, দ্রুত পরিচিতি লাভ করেন। এসএম সুলতানকে দেশে তো বটেই, বিশ্ব দরবারে জায়গা করিয়ে দিতে ছফা এককভাবেই ভূমিকা রেখে গেছেন। এর বিপরীত হলে এসএম সুলতান হারিয়ে যেতো কি-না তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন ছিল না বললেই চলে। এর পরের ইতিহাসটা আমাদের সবারই জানা আছে।
বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় কলকাতার বই আসতো। আহমদ ছফা এর বিরোধীতায় নামেন। তার বিরোধীতার ফলে বই মেলায় কলকাতার বই আসা বন্ধ হয়। ছফা কাজটা করেছিলেন দেশের লেখকদের কল্যাণের জন্য। এ ঘটনায় এদেশেরই লেখক শওকত ওসমান আহমদ ছফাকে বাজে লোক বলে মন্তব্য করেন। এরপর আহমদ ছফা শওকত ওসমানকে নিয়ে নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে দোকানে নিয়ে যান। গিয়ে জিজ্ঞেস করেন শওকত ওসমানের কোনো বই এসব দোকানে আছে কি-না। বই তো নেই-ই শওকত ওসমানকেও কোনো বইয়ের দোকানদার চিনতে পারলেন না। তখন কলকাতার একজন সাধারন মানের লেখকের নাম বলতেই অনেকগুলো বই বের করে দিলেন দোকানদার। আহমদ ছফা শওকত ওসমানকে বললেন,
"দেশটা আমরা বাল ছেঁড়ার জন্যে স্বাধীন করেছি?" এটিই আহমদ ছফার দর্শন, আহমদ ছফার দেশপ্রেম।
১৯৬৮ সালে আইয়ুব খানের সরকার রবীন্দ্র-সঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এর প্রতিবাদে সারাদেশের শিক্ষিত মানুষ মিছিল-মিটিং করলেন। সেই সময় আহমদ ছফার উদ্যোগে তৎকালীন শিল্পকলা একাডেমির সেক্রেটারি কাজী সিরাজ ও অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সহায়তায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ সংকলন ছাপানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সম্পাদনায় ‘স্টুডেন্ট ওয়েজ’ থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে এরকম একটি শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তোলা ছফার পক্ষেই সম্ভব ছিল। একই বছর কবীর চৌধুরীর আগ্রহে বাংলা একাডেমি জার্নালের জন্য ‘Literary ideals in Bengal’ নামে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন আহমদ ছফা।
১৯৬৯ সালে আহমদ ছফা ‘স্বদেশ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করেছিলেন, যেটার সম্পাদক ছিলেন তিনি নিজেই। সেই পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ড. মফিজ চৌধুরী, সরদার ফজলুল করিম, সত্যেন সেন, ড. আহমদ শরীফ, মুনতাসির মামুন ও অসীম সাহা এবং আরও অনেক গুনিজন।
লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদকে প্রতিষ্ঠিত করতে আহমদ ছফার অবদান অনস্বীকার্য। হুমায়ুনের প্রথম উপন্যাস 'নন্দিত নরকে' প্রকাশে ছফার ভূমিকা কে না জানে? মুহম্মদ জাফর ইকবাল বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়াশোনা করছিলেন তখন তাঁদের পরিবারে অর্থকষ্ট ছিল। সেই সময় আহমদ ছফা মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকা অফিসে নিয়ে গিয়ে কার্টুনিস্টের কাজ জুগিয়ে দিয়েছিলেন। জাফর ইককবাল ভাষায়, আহমদ ছফা 'চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত' একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক। ড. জাফর বলেন- আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের মাঝে আহমদ ছফার মতো একজন সাহসী আর জিনিয়াসের জন্ম হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় তরুণ কবি আবুল হাসানের পুনঃভর্তি হওয়া দরকার ছিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। কিন্তু আবুল হাসানের হাতে তখন কোনো টাকা ছিল না। আহমদ ছফা বিষয়টি জানতে পারেন। তখন আহমদ ছফা নিজের বই প্রকাশের ‘রয়্যালিটির’ টাকা আবুল হাসানের হাতে তুলে দিয়েছিলেন পুনঃভর্তি হতে। স্বাধীনতার পর কোনো কারণে কবি ফররুখ আহমদের সরকারি টাকা বন্ধ হয়ে যায়। তখন তিনি অসুস্থ্যও ছিলেন। আহমদ ছফা এ বিষয়টি জানতে পেরে খুব ক্ষেপে যান। একজন সাহিত্যিক অসুস্থ্য অথচ কোনো এক অজানা অজুহাতে সরকারের তরফ থেকে টাকা প্রদান বন্ধ থাকবে, এটা আহমদ ছফা মেনে নেয়ার মানুষ ছিলেন না। তিনি এ বিষয়টি নিয়ে হৈ-চৈ তুলে ফেললেন। সংশ্লিষ্ট সবখানে প্রতিবাদ করলেন। পত্রিকায় লিখলেন। অবশেষে সরকারের তরফ থেকে ফররুখ আহমদকে টাকা প্রদানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ’৭৫-এ তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণকে অজ্ঞাত কারণে আর্মি গ্রেফতার করে রমনা থানা হাজতে কাস্টোডিয়ান হিসেবে জমা দিয়ে গিয়েছিল। এই খবর পাওয়া মাত্র নির্মলেন্দু গুণকে ছাড়াতে থানায় ছুটে গিয়েছিলেন আহমদ ছফা। নির্মলেন্দু গুণকে ছেড়ে দিতে তিনি থানার ওসির সাথে বাগবিতণ্ডা পর্যন্ত করেন। সাত দিনের মধ্যেই নির্মলেন্দু গুণ ছাড়া পান। আরেক প্রতিবাদী তরুণ কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে তিনি খুব স্নেহ করতেন। যখন তিনি পাকস্থলীর আলসারে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তখন তাকে নিয়মিত দেখতে হাসপাতালে যেতেন আহমদ ছফা। ফিরে আসার সময় টাকাভর্তি একটা খাম রেখে আসতেন রুদ্রের বালিশের নিচে।
১৯৭১ এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশ নামক মহাকাব্যটি যখন রচিত হচ্ছিলো। খোলা আকাশের নীচে উদভ্রান্ত (?) একটি মানুষ চার আনা দামের একটি পত্রিকা উপস্থিত জনতার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। পত্রিকার নাম 'প্রতিরোধ'। শিরোনামের নীচে ক্যাপশন-স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র। চিন্তা করুন, কি মাত্রার উদভ্রান্ত (?) হলে স্বাধীনতার অমৃতস্বাদ গ্রহণের কতো আগে এ ক্যাপশন লেখা যায়! কত সাহস থাকলে এ দূঃসাধ্য জয় করা যায়! পত্রিকা বিক্রয়লব্ধ অর্থ যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতার জন্য জমা রাখা হয় একজনের কাছে। সে অর্থ আর কখনই এ দেশের কাজে ব্যবহৃত হয়নি। জমাগ্রহণকারী নিজ উদরে জমা করে দিয়েছে চিরতরের জন্য। এ উদভ্রান্ত লোকটিই ছিল মনিষা আহমদ ছফা।
ষাটের দশকে সাহিত্য জগতে পা রাখেন মহাত্মা আহমদ ছফা। সমসাময়িক তো বটেই সব সময়ের উপন্যাস লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই ব্যতিক্রম। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় আহমদ ছফার প্রথম উপন্যাস ‘সূর্য তুমি সাথী’। বক্তব্যের স্পষ্টতা আর তীব্রতার জন্য খুব দ্রুত পাঠকদের মাঝে সাড়া ফেলে দেন তিনি। সাম্প্রদায়িকতার প্রতিবাদ, শ্রেণি বৈষম্য, শোষণ, সম্পদের অসম বণ্টন নিয়ে বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত উৎকৃষ্ট এই বইটি লিখেছিলেন ২৩ বছর বয়সি মৌলবি ছফা। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে স্বাধীনতার পথে হাঁটতে থাকা বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিশেবে প্রকাশিত হয় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমি থেকে সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন তিনি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণ কাহিনী সব মিলিয়ে ত্রিশটিরও বেশি গ্রন্থের প্রণেতা আহমদ ছফা। তার লেখাগুলোর দিকে তাকালে একটি বিষয় নজরে পড়বে। প্রায় প্রতিটি লেখাই সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমসাময়িক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে। তাঁর সব লেখায় নির্দেশক বিন্দু আছেই। প্রায় লেখকের যা থাকে না। সাধারণত ছোট ভলিউমে বই বের করতেন আহমদ ছফা। এই ছোট বইগুলোই চট করে পাঠকদের মনে জায়গা করে নিত। কেননা তাতে থাকত গণমানুষের কষ্টের প্রতিফলন, তাদের জীবনের দুর্দশার চালচিত্র।
আহমদ ছফা তিরিশটির বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। তার লেখা প্রবন্ধমূলক গ্রন্থগুলো সর্বাধিক আলোচিত ছিল। তার প্রবন্ধমূলক গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’-১৯৭১, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-১৯৭২, ‘বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে’-১৯৭৫, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’-১৯৭৭, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’-১৯৮১ , ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’-১৯৮৯ , ‘রাজনীতির লেখা’-১৯৯৩, ‘নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ’-১৯৯৫, ‘সঙ্কটের নানা চেহারা’-১৯৯৬, ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা : বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’-১৯৯৭, ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’-১৯৯৮, ‘বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র’-২০০১, ‘আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’-২০০২, ‘সেইসব লেখা’-২০০৮। তার গল্পগ্রন্থগুলো হচ্ছে, ‘সূর্য তুমি সাথী’-১৯৬৭, মাজার ও ধর্ম ব্যবসায় আড়ালে রাজনীতির উত্থান-পতন নিয়ে ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’-১৯৮৯, মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের কাহিনী নিয়ে ‘অলাতচক্র’-১৯৯০, ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তি সংগ্রামের উজ্জ্বীবনায় জাতি সত্তার জাগরণের অন্তর্সত্য নিয়ে ‘ওঙ্কার’-১৯৯৩, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তবিক হাল-চাল নিয়ে ‘গাভীবিত্তান্ত’-১৯৯৪, আত্মজীবনী ও প্রচলিত সমাজ কাঠামোর বিরুদ্ধে ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’-১৯৯৬, কালজয়ী উপন্যাস ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’-১৯৯৬, সমাজপতিদের ভিতরের চেহারা নিয়ে সাহস আর বাস্তবতার প্রকাশ 'মরন বিলাস' এবং ‘নিহত নক্ষত্র’-১৯৬৯, জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের চিন্তা, মনন, দর্শন নিয়ে 'যদ্যপি আমার গুরু'। কবিতার ক্ষেত্রেও সমুজ্জ্বল ছিলেন আহমদ ছফা। ‘জল্লাদ সময়’ ও ‘দুঃখের দিনের দোহা’-১৯৭৫, ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’-১৯৭৭, ‘লেনিন ঘুমোবে এবার’-১৯৯৯, ‘আহিতাগ্নি’-২০০১ তার কাব্যগ্রন্থ। অনুভূতির প্রত্যক্ষ প্রকাশ, লোকজ ভাষার ব্যবহার, পুঁথিপুরাণের শব্দ প্রয়োগ ও বাক্যরীতির সঠিক চয়নে তার কবিতাগুলো যেনো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আহমদ ছফার অন্যতম জনপ্রিয় একটি বই ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এ ছাড়াও তিনি ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর গল্প ও শিশুতোষ ছড়া গ্রন্থ রচনা করেন।
বাংলাদেশের সাহিত্য ইতিহাসের অন্যতম প্রতিবাদী এবং প্রগতিশীল লেখক আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া ছিলেন একজন কৃষক এবং মা আসিয়া খাতুন ছিলেন গ্রাম্য গৃহিণী। ছফা স্পষ্টভাবে বলতেন-"আমার পূর্বপুরুষ ছিল কৃষক, এ পরিচয়ে আমি গর্ববোধ করি।" দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার হাতে গড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হয় ছফার। ১৯৬০ সালে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন তিনি। ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। যদিও সেখানে খুব বেশি দিন ক্লাস করেননি ছফা। ড. আহমদ শরীফের সাথে মতের অমিলের জের ধরে ক্লাস ছাড়েন ছফা। আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো, সেই আহমদ শরীফের অধ্যাপক পদে পদোন্নতিতে মুল্যায়নের জন্য যুক্ত করা তিনজনের মতামতের মধ্যে অন্যতম মতামত ছিল আহমদ ছফার। ১৯৬৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ছফা। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামে আহমদ ছফা পিএইচডি করতে ইচ্ছুক হলেন। তখনকার প্রচলিত নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে এমএ পাশ না হওয়া সত্ত্বেও আহমদ ছফা সেই বৃত্তিটা পেয়েছিলেন। ছফা ঢাকা বিশ্বদ্যিালয় থেকে ১৯৭১ সালে প্রাইভেটে এমএ পাশ করেন। তিনি গবেষণা করতে চেয়েছিলেন “১৮০০ থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব”- বিষয় নিয়ে। এ গবেষণা বৃত্তি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নিজের প্রয়োজনে শুরুতেই আহমদ ছফা পরিচিত হন শিক্ষকদের শিক্ষক খ্যাত অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে। 'যদ্যপি আমার গুরু'-বইয়ে আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ও বিশদভাবে আলোচনা করেছেন আহমদ ছফা। বই এবং টাকা এই দুটি জিনিস যখনই চাইতেন আহমদ ছফা, কখনোই আব্দুর রাজ্জাক খালি হাতে ফিরিয়ে দেননি। একবার আহমদ ছফাকে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আপনে এখন কী পড়াশোনা করবার লাগছেন?’
ছফা বললেন, ‘কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আপনি যদি কিছু বইয়ের নাম বলে দিতেন।’
আব্দুর রাজ্জাক শব্দ করেই হেসে উঠলেন। বললেন, ‘একই কথা মি. হ্যারল্ড লাস্কিরে কইছিলাম। তিনি লাইব্রেরি দেখিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, মাই বয় গো অ্যান্ড সোক।’
সেই যে আব্দুর রাজ্জাক ছফাকে লাইব্রেরি দেখিয়েছেন, ছফা সেখানে গিয়ে এমনভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে, পরবর্তীতে পিএইচডির গবেষণা কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। আসলে পিএইচডি ছফাকে অধ্যাপক রাজ্জাকের চেয়ে বেশি কাছে টানতে পারেননি। বলা যায়, ছফা পিএইচডিটি করেননি। এ জন্যই হয়তো ছফা বলেছিলেন, বৃহৎ কিছুর জন্য ক্ষুদ্র কিছু ত্যাগ করা অনেক সময় মহতের চেয়েও মহত্তর হয়। এ নীতিতেই সলিমুল্লাহ খান প্রথম আলোতে লিখেন না। সমাজে আরো অনেকে আছেন যারা নীরবে নিবৃতে সমাজের মৌলিক কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য বা প্রত্যাশায় এভাবে স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে আসছে অথবা নিজেকেই বিসর্জন দিচ্ছে। এটি ছফার প্রভাব কি-না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তির পক্ষে কথা বলা, শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালে আহমদ ছফার একক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় সাহিত্য সংগঠন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির।’ লেখকদের প্রতিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে এই সংগঠন থেকে সাহিত্য পুরস্কারের আয়োজন করেছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে এই সংগঠন থেকে প্রথম সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার পেয়েছিলেন কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ ও হুমায়ূন আহমেদ। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে আহমদ ছফার পরিকল্পনা ও শ্রমে গড়ে উঠা ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ থেকে স্বয়ং ছফাকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। এর পেছনে তিনি বদরুদ্দীন উমরকে দায়ী করেছেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে সেই সংগঠন থেকে আহমদ ছফা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও তিনি সেটা গ্রহণ করেননি। নব্বই দশকে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে উপকূলে ব্যাপক সহায়তা প্রদানে অগ্রণি ভূমিকা ছিল বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি-বিজিএস এর। এই বিজিএসকে বাংলাদেশে এনে কাজ করার জন্য পরিবেশ সৃষ্টির বলতে গেলে একমাত্র অবদান ছিল আহমদ ছফার। পরে ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে আহমদ ছফাকেই ছাড়তে হয়েছে বিজিএস। ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় উপদেষ্টা ছিলেন আহমদ ছফা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কট্টর সমালোচক হলেও সত্য উচ্চারণে ছফা ছিলেন বজ্রকণ্ঠী। ছফা বলতেন, “বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘বলাকা’ নয়, ‘সোনার তরী’ নয়, ‘গীতাঞ্জলি’ নয়; বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘আর দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ট্রাজিডির পর আহমদ ছফার বেশ ব্যথিত হয়েছিলেন। মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের পর সেদিন তথাকথিত কোনো বুদ্ধিজীবীর উচ্চকণ্ঠ শোনা যায়নি, কোনো রাজনীতিক সাহস নিয়ে ঘর থেকে বের হননি। ঢাকা শহরে কোথাও কোথাও মিষ্টি বিতরণ ও ‘নাজাত দিবস’ পালন করা হয়েছিল। অথচ সেই বৈরী পরিবেশে ‘হলি ডে’ পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন আহমদ ছফাই।
আহমদ ছফার সাহিত্য কর্ম-
সলিমুল্লাহ খান ও আরো অনেকের মতে, আহমদ ছফা বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্ব সাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক। শক্তিধর লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতে, ছফা গল্প বলার কলা অল্প বয়সেই রপ্ত করেছিলেন। তাই পাঠকরা তার ডাকে সাড়া দেয়।
আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। তাঁর জীবদ্দশায় আহমদ ছফা রচনাবলি প্রকাশ শুরু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর নুরুল আনোয়ারের সম্পাদনায় ছফার রচনাবলি ৯ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। জীবিত থাকাকালীন আহমদ ছফা বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লেখা অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখা হলো আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা-যদ্যপি আমার গুরু, গাভী বিত্তান্ত, বাঙ্গালী মুসলমানের মন, বুদ্ধি বৃত্তির নতুন বিন্যাস, ওঙ্কার, সূর্য তুমি সাথী, অলাতচক্র, সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে মুক্তধারা থেকে প্রকাশ পায় ছফার প্রবন্ধ গ্রন্থ জাগ্রত বাংলাদেশ (প্রকাশকাল- শ্রাবণ ১৩৭৮ বা জুলাই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ)। ১৯৭২-এ প্রকাশ পায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস এবং ১৯৮১-এ বাঙালি মুসলমানের মন গ্রন্থ প্রকাশ পায়।
ছফা জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটের 'ফাউস্ট' অনুবাদ শুরু করেন ১৯৭০ সালে। মুক্তধারা থেকে ফাউস্টের অনুবাদ বের হওয়া শুরু হয় ১৯৮৬ সালে। 'ফাউস্ট' পুরোটা অনুবাদ করেননি ছফা। এর কারণ হিশেবে ছফা বলেছেন, গ্যেটের অনুবাদক হয়ে বেঁচে থাকতে চাননি তিনি। কতোটা সাহস আর নিজের উপর কতোটা বিশ্বাস থাকলে এরকম একটি কথা বলা যায় তা চিন্তা করা যায় না। ছফা সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন। তিনি গ্যেটের অনুবাদক নন, তিনি ছফা, মহাত্মা আহমদ ছফা।
আহমদ ছফা ও তার রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও বুদ্ধিজীবীকে অনুপ্রাণিত করেছে, তাদের মাঝে অন্যতম সলিমুল্লাহ খান, ড. সুদীপ্ত হান্নান, হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ। হুমায়ূন আহমেদ আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাকে নিজের মেন্টর বলে উল্লেখ করেছেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ‘ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যেকোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।’ বর্তমানে আহমদ ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত। এই কীর্তিমান ২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ্য অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের পাশে তাকে দাফন করা হয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ‘লেখক শিবির পুরস্কার’ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখিয়েছেন। ১৯৮০ সালে ‘ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার’ এবং ২০০২ সালে ‘মরণোত্তর একুশে পদক’-এ ভূষিত হন আহমদ ছফা। সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন মনিষা আহমদ ছফা।
শুভ জন্মদিন, সলিমুল্লাহ খানের কথায় "আমাদের সময়ের নায়ক" আর জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের "মৌলবি ছফা"।
ঋণ-
০১. আহমদ ছফা রচনাবলী (০১ থেকে ৯ম খন্ড)-নুরুল আনোয়ার।
০২. আহমদ ছফা সঞ্জীবনী-সলিমুল্লাহ খান।
০৩. ছফামৃত-নুরুল আনোয়ার।