Advertisement


আমার প্রথম বই -জাহেদ সরওয়ার

উইলিয়াম ফকনার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ‘প্রথম বইটাই যথেষ্ট একজন লেখকের নিজেকে খাদে খুঁজে পাওয়ার জন্য’। কথাটা হাছাই মনে হয়। প্রথম বইটাকে অনেকেই অস্বীকার করার পক্ষে। অনেকের প্রথম বইয়ে আস্থা থাকে না। কিন্তু সেই প্রথম বই ভাল না হলেও বইটা লেখককে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। যেখান থেকে ভাল বই লেখার কমিটমেন্ট তৈরি হয় । আবার এরকমও আছে যে প্রথম বইটা এতই ভাল যে সে আর কোনো বই লিখতেই পারলো না অথবা ভাল কিছু লিখে উঠতে পারল না। সবকিছু মিলিয়ে একজন লেখকের জন্য প্রথম বইটা একটা ক্ষতচিহ্নের মতো। এখনো মনে আছে ১৯৯৬’র শেষের দিকে। ঢাকার এলোমেলো দিনকাল ছেড়ে কিছুদিনের জন্য কক্সবাজার থিতু হয়েছিলাম প্রায় পারিবারিক সিদ্ধান্তে। তখনো আমার কোনো বই প্রকাশিত হয় নাই। মাবাবাভাইবোন চরম আতংকিত আমার ভবিষ্যত নিয়ে, এখনো। বাবার উদ্যোগেই বার্মিজ মার্কেটে আমার জন্য একটা দোকান ভাড়া নেয়া হলো। চারদিকে রাখাইন মেয়েরা দোকানদারি করে। দুএকজনের সঙ্গে পূর্বপরিচিত পরিবেশটা খারাপ লাগলো না। কবিতা লেখা ছাড়া বলতে গেলে তখনোব্দি কোনো কাজই করি না। ব্যবসার আমি কি বুঝি ভাব। পত্রিকায় কবিতা ছাপা হওয়ার সুবাধে অল্পদিনের মধ্যেই সবাই জেনে যায় দোকানদারি করলেও ছেলেটা কবি। মাথাভর্তি লম্বাচুল। শরীর স্বাস্থ্যও ভাল। কিন্তু কক্সবাজার শহরের নি:সঙ্গতা অল্প দিনেই আমাকে কাহিল করে তোলে। সমস্যা ছিল বুঝতে না পারা আর বুঝাতে না পারার। একটা রাখাইন মেয়েকে খুবই ভাল লেগে গেল। কিন্তু ওরা তো খুবই কনজারভেটিভ। এটা অল্প সময়েই জেনে গেলো অন্যান্য ব্যবসায়ীরা। সবাই হাসাহাসি করতো। মেয়েটা কক্সবাজার কলেজে পড়তো তখন। কলেজ শেষে বাসায় রেস্ট নিয়ে সেজেগুজে মেয়েটি যখন আমাদের মার্কেটের সামনে দিয়ে অন্য একটা মার্কেটে যেতো আমি প্রতিদিন আমাদের মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ওর বান্ধবীদের অনেকেই জানে তাকে আমার খুবই ভাল লাগে। কিন্তু অদ্ভুদভাবে তার সঙ্গে আমার কথা হতো না। সেও তাকিয়ে থাকতো ভাললাগার কথা বলতে না পারা এক নির্বাক তরুণ তুর্কির দিকে। তারদিক থেকেও আগ্রহ দেখলাম একদিন। সে সচরাচর যেই সময়ে আসে একদিন আমি দাঁড়াইনি। দেখলাম সে নিজেই মার্কেটের ভেতর চলে আসলো। আমার দোকানের দিকে তাকালো অবিশ্বাসের চোখে। সেদিন যে কি ভাল লাগলো। সে পাশের দোকানে এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে চলে যাবার
সময় আবারো তাকালে আমি বুঝতে পারলাম। অলিখিত সংযোগ স্থাপনের সিগনেল। এরপর বিচে তার এক বান্ধবী আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলো। ওর বান্ধবীর গল্পই শুনলাম শুধু আমরা কথা বলতে পারলাম না তেমন। সে আমাকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল সেটাই আমার ভেতর বই প্রকাশের আগুন জ্বেলে দেয়। তার বান্ধবী যখন তাকে বললো যে আমি একজন কবি। তখন সে গ্রীবা বাকিয়ে খুবই উৎসাহের সঙ্গে বলেছিল বাংলাভাষায়, আপনার কি কবিতার বই বের হয়েছে? দিয়েন তো আমাকে। প্রশ্নটা আমাকে একই সঙ্গে বিভ্রান্ত ও আশাবাদী করে তোলে। আমি আমার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে নিশানা পেয়ে গেছি। অনেকগুলো কবিতা জমেছে। বই করবো করবো বলে করাই হচ্ছে না। ঢুকাই হচ্ছে না বই বার করার হ্যাপায়। মনে মনে তখনই সিদ্ধান্ত নিই আসন্ন ফেব্রুয়ারিতে আমার প্রথম কবিতার বই বের হবে। এরপর কবিতা গুচাই। তখন আমি খুব তসলিমা নাসরিন পড়ছিলাম। ফলে চারদিক প্রকাশনের নামটা আমার মনে গেঁথে থাকে। চারদিক প্রকাশনী তখন তসলিমা নাসরিনের অনেক বই বের করেছে। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির দিকে তখন শীত পড়তো প্রচুর। আর শীতকাল মানে বার্মিজ স্টোরের রমরমা ব্যবসা। প্রতিদিন পনের বিশহাজার টাকা বিক্রি। কারণ শীতকালে কক্সবাজারে প্রচুর পর্যটক। যত পর্যটক তত ব্যবসা। আমার আর তর সইছে না শুধু ইচ্ছে করছে একটা বই বানিয়ে মেয়েটার হাতে তুলে দিই। নিজের সঙ্গে দ্বন্ধযুদ্ধে অবতীর্ণ হই। ব্যবসা না কবিতা। কবিতা না ব্যবসা। তখন আমি জীবনানন্দেও ডুবে ছিলাম। দোকানের নামও রেখেছিলাম বনলতা। রাতে শুয়ে শুয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরের দিন রাতেই একদিনের বিক্রির টাকা নিয়ে আমি ঢাকার গাড়িতে চড়ে বসি। হোটেল রুমে ব্যাগ রেখে ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠে রওনা দিলাম বাংলাবাজার। চারদিক প্রকাশনীর ঠিকানা আমার কাছে আগে থেকেই ছিল। চারদিক প্রকাশনীতে গিয়ে দেখি অনেকবইপত্র চারিদিকে। টেবিলে একটা লিকলিকে লোক বসে আছে। আমি তাকে সালাম দিয়ে বললাম আমার বাসনার কথা। সে নিজের পরিচয় দিল হুমায়ূন কবীর ঢালি। ঢালি ভাইও আজ শিশুসাহিত্যে বেশ নাম করেছে। আমার টার্গেট ছিল আমি পান্ডুলিপি দেব কেউ করতে চাইলে করবে না হলে নিজের টাকা দিয়ে হলেও বই করে ফেলবো। ঢালি ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলো তিনি বললেন নতুনদের বই করার ঝুকি কোনো প্রকাশকই নিতে চায় না। তিনি আমাকে একটা হিসাব দিলেন। ইকবাল হোসেন সানু তখন জনপ্রিয় আজকের সুর্যোদয়ের কার্টুনিস্ট। তাকে দিয়ে প্রচ্ছদ আকানো হলো। ঢালি ভাই বললো তার সঙ্গে অনেক কবির যোগাযোগ তিনি কাউকে দিয়ে একটা ভূমিকা লেখাবেন। তখন বাংলবাজারের সেরা কবি ছিলেন নির্মলেন্দু গুণ ও মহাদেব সাহা। বিষয়টি ঢালি ভাইই দেখলেন। আমি দিনে একবার বাংলাবাজার যেতাম কাজের অগ্রগতি দেখতে। বইটা প্রুপ রিডারের কাছ থেকে আসছে। কালো কালো অক্ষরগুলো লাল চিহ্ন দেয়া। মানে প্রক্রিয়ার ভেতর পড়ে গেছে। আরেকদিন বললেন ম্যাকাপ হচ্ছে। ঢালি ভাইকে অনুরোধ করলাম সেখানে নিয়ে যেতে কারণ আমার মনে হচ্ছিল আমার সন্তান সাজছে তাকি না দেখে পারি। তিনি সেখানে নিয়ে গেলেন। আরেকদিন তিনি বললেন ছাপাখানায় চলে গেছে। ছাপাখানায়? বইটা তাহলে ছাপা হচ্ছে? ঢালি ভাইকে আবার ধরলাম ভাই চলেন ছাপাখানায় যাই। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল বইটা কিভাবে তৈরি হচ্ছে তার প্রত্যেকটা প্রক্রিয়া দেখা। কিন্তু ঢালি ভাইয়ের কাছে এগুলো ডালভাত। বারবার তার বিরক্তি উৎপাদন করছি তিনি প্রশ্রয় দিচ্ছেন। অবশেষে চারদিক প্রকাশনীর ব্যানারে বইটা যখন প্রকাশিত হলো সেখানে দেখলাম মহাদেব সাহা ভূমিকা লিখেছেন। মহাদেব সাহা তখন স্কুল পড়–য়া বা সদ্য কলেজ পড়–য়া তরুণ তরুণীর কাছে খুবই জনপ্রিয়। কারণ তার কবিতার বইগুলোর নামও হালকা প্রথম প্রেম প্রথম অনুরাগের সঙ্গে মানানসই। বইয়ের নাম হলো ‘হৃদয় তদন্ত’। আমার হৃদয়টাই তখন আসলে তদন্ত হচ্ছিল। আমি চাচ্ছিলাম যার প্রেরণায় বইটা করছি তাকে বইটার মাধ্যমেই প্রপোজ করতে। তখন বইমেলা প্রায় শেষের পথে। পুরা ফেব্রুয়ালি লেগে গেলো বইটা ছাপতে। ফেব্রুয়ারিতে সব ছাপাখানাইতো ব্যস্ত। এরপর বইটা নিয়ে ঢালি ভাই সহ বিভিন্ন স্টলে দিয়ে আসি বইমেলায়। পরদিন আমি শ খানেক কাঁচা বই নিয়েই রওনা দিই কক্সবাজার। কক্সবাজার গিয়ে তো দেখি বাবা রেগে কাই হয়ে আছে। কারণ এমন ব্যবসার মরশুমে আমি দোকানে তালা মেরে কিসের কবিতার বই ছাপতে গেছি। এই অপরাধে তিনি মাসখানেকের জন্য আমাকে দোকান থেকে বিতাড়িত করেন। আমার জন্য এই শাস্তি শাপেবর হয়। সবাইকে হাতে হাতে বইটা দিতে পারি। সবাই অবাক হয়। এতদিন মুখস্থই বলতো ছেলেটা কবি। এখন কিনা নিজের লেখা বই হাতে এক্কেবারে। যারা কবিতা পড়ে না তাদেরকে জোর করে বইটা বিক্রি করলাম। অপেক্ষায় থাকলাম রাখাইন মেয়েটার। সে অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এতদিন কোথায় ছিলাম এটাই তার চোখে প্রশ্ন। আমি তার হাতে বইটা তুলে দিলাম। বললাম তোমার জন্য এটা। সে হাতে নিয়ে একবার তাকায় বইয়ের নাম ও লেখকের নামের দিকে। তারপর আমার দিকে তাকায়। অবাক হয়ে বলে আপনার বই! মনে হলো সেই ছিল বই প্রকাশের স্বার্থকতা। কিন্তু ফকনারের কথাটাই সত্য যে প্রথম বইই যতেষ্ট। পরের বইগুলোর পরিকল্পনা জাগিয়ে তুলতে।