Advertisement


কক্সবাজারে জেপিটিটিসিতে ফেলের হার ৭৫ শতাংশ, প্রকল্পের অনুমতি স্থগিত


বিশেষ সংবাদদাতা।। কক্সবাজারে এনজিও সংস্থা স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার মালিকানাধীন জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের (জেপিটিটিসি) বিরুদ্ধে ফলাফল বিপর্যয়, অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে সরকারি তদন্তেও। ফলে, গতকাল এক পত্রমূলে প্রতিষ্ঠানটির সনাদায়ন কার্যক্রম পরিচালনার সরকারি অনুমতি স্থগিত ঘোষণা করেছে এসেট প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। একইসাথে অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে মন্ত্রনালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত দফায় কক্সবাজার এসে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। -সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দৈনিক কক্সবাজারে গত সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত সংবাদে জেপিটিটিসির অনিয়মের চিত্র ফাঁস হলে, বিষয়টি নিয়ে সরব হয় প্রশাসন ও সরকারের কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। গঠিত হয় দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি, যারা গত ১৩ সেপ্টেম্বর মাঠ পর্যায়ে তদন্ত শুরু করে অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পান। তদন্ত কমিটি ১৮ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে চুড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকতর তদন্তের স্বার্থে প্রতিবেদন দাখিলের সময় কিছুটা বাড়ানো হয়। 

তদন্তের দ্বিতীয় দফায় গতকাল (সোমবার) কক্সবাজারে আসেন এসেট প্রকল্পের অফিসার মো. আকিব বিশ্বাস। তিনি সরেজমিনে জেপিটিটিসির কার্যক্রম ঘুরে দেখেন এবং দৈনিক কক্সবাজারে প্রকাশিত রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করেন। তিনি জেপিটিটিসির কার্যালয় পরিদর্শন করে বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করেন এবং দৈনিক কক্সবাজার কার্যালয়ে এসে প্রতিবেদকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।

তদন্ত শেষে তিনি বলেন- প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। পত্রিকায় যেসব অভিযোগ এসেছে, তা যাচাই করেছি এবং যার অধিকাংশই সত্য বলে প্রতিয়মান হয়েছে।

তিনি আরও জানান, ঢাকায় ফিরে তদন্ত কমিটির অপর সদস্যের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন চলতি সপ্তাহেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করা হবে। ইতোমধ্যেই প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জেপিটিটিসির একটি প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত করেছে বলেও জানান তিনি। 

জানা গেছে- কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গঠিত এসিলারেটিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন (এসেট) প্রকল্পটি মূলত বেকার যুবসমাজ ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আত্মনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য গৃহীত হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে জেপিটিটিসি- রিকগনিশন অফ প্রিয়র লার্নিং (আরপিএল) নামে তিন দিন মেয়াদি প্রশিক্ষণ চালু করে। প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীকে দুপুরের খাবারসহ ৩ হাজার টাকা ভাতা, মানসম্পন্ন ব্যাগ, নোটপ্যাড, কলম, এপ্রোন, এবং চা-নাস্তার ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল।

কিন্তু অনুসন্ধান ও তদন্তে দেখা যায়, বাস্তবে অধিকাংশ প্রশিক্ষণার্থী পেয়েছেন মাত্র ৯'শ থেকে ১ হাজার টাকা ও একটি সার্টিফিকেট। কেউ কেউ জানিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে উল্টো টাকা নেওয়া হয়েছে প্রশিক্ষণ করানো এবং সার্টিফিকেট দেয়ার  বিনিময়ে।

একাধিক ভুক্তভোগীর ভাষ্য অনুযায়ী, খাবারের মান ছিল অত্যন্ত নিন্মমানের, প্রশিক্ষণ পরিচালনায় ছিল চরম গাফিলতি, এবং সার্টিফিকেট প্রদানে ছিল অনিয়ম। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, প্রশিক্ষণের নামে কেবল লোক দেখানো কার্যক্রম চালিয়ে প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। জেপিটিটিসি প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে এসেট প্রকল্পের কোনো শর্তই মানা হয়নি। অনেক ভুক্তভোগী সরাসরি এমন অভিযোগও করেছেন।

প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তদন্ত এখন শুধু এসেট প্রকল্পেই সীমাবদ্ধ নেই, পূর্বের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। সরকারি অর্থের অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগের ভিত্তিতে বিভিন্ন সংস্থা পৃথকভাবে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে বলেও জানা গেছে। 

এছাড়াও জানা গেছে, জেপিটিটিসি প্রশিক্ষণের কার্যক্রম চালানোর ক্ষেত্রে এসেট প্রকল্পের কোনো শর্তই মানা হয়নি। প্রশিক্ষণার্থীদের যথাযথ রেজিস্ট্রেশন, প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী এসেসমেন্ট এবং ফলাফল মূল্যায়ন- কিছুই হয়নি বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।

গতকাল (৬ অক্টোবর) সরকারের কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব ও এসেট প্রকল্পের পরিচালক মীর জাহিদ হাসান সাক্ষরিত এক পত্র সূত্র জানা গেছে- সরকারের অর্থায়নে জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের আওতায় ২০২৪ সালের মার্চ হতে তিনদিন মেয়াদি আরপিএল সনদায়ন কার্যক্রম চলে আসছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের এসেসমেন্ট ফলাফল পর্যালোচনায় বড় অসংগতি পাওয়া যায়। এখানে পাশের হারের চেয়ে ফেলের হার বেশি ধরা পড়ে। পত্রে উল্লেখ করা পরিসংখ্যানে দেখা যায় জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে ফেলের হার ৭৫ শতাংশ। একই পত্রমূলে ঢাকা ও বগুড়ার আরও দুইটি প্রতিষ্ঠানের এমন কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।

এসেট প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. সবুজ আলম বলেন- সেপ্টেম্বর মাসের এসেসমেন্ট রিপোর্ট সন্তোষজনক ছিল না। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার আগেই আমরা প্রতিষ্ঠানটির প্রশিক্ষণ কার্যক্রম অক্টোবর থেকে স্থগিত করেছি। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ বহাল থাকবে। তিনি আরও জানান, প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

জানা গেছে- এনজিও স্কাস এবং এর চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা দীর্ঘদিন ধরেই কক্সবাজারে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের সাথে যুক্ত। তবে এবার তাদের পরিচালিত প্রতিষ্ঠান জেপিটিটিসির বিরুদ্ধে ওঠা এ ধরনের প্রমাণিত অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে জনমনে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।