Advertisement


বাংলা ব্যবহারে আমাদের মানসিকতা

 মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন

মাতৃভাষার চর্চা ও লালনের দাবিতে পৃথিবীর বুকে যুদ্ধ করা জাতি একমাত্র আমরাই। আমাদের আবেগ আর অনুভূতির সাথে দাবি আদায়ের অদম্য স্পৃহাই ভাষা আন্দোলনের বাহ্যিক প্রকাশ। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে আমরা পথ চলতেছি। মাতৃভাষার চর্চাটি সেভাবে তো নয়ই, বরং অনেক পিছনেই পড়ে আছে। কেবল এই একটি জায়গায় আমরা প্রয়োজনীয় আন্তরিক আর যত্নবান হলে আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আর দর্শন চর্চা নিশ্চিতভাবেই কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে যেতো। সেটা হয়নি। একেবারে দায়িত্ব নিয়েই বলছি কার্যকরভাবে এ ক্ষেত্রটিতে আমাদের পথচলা শুরুই হয়নি।

আমাদের বিচারালয়ের নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষা চালু হয়েছে, উচ্চ আদালতে এখনও হয়নি বললে ভুল বলা হবে না। এটা নিয়ে অনেকের মধ্যে মতভেদ আছে যে, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার চর্চা দরকার আছে কি-না? আমি মনে করি খুব দরকার আছে। এখান থেকে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলে সেটা কার্যকর সহজ হবে।

সময়ে সময়ে শব্দ যোগ-বিয়োগের জন্য উচ্চ মেধা সম্পন্ন একটি কমিটি থাকা খুব প্রয়োজন। এখন, সবেধন নীলমনি বাংলা একাডেমি যা করতে বাধ্য হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে এ রকম কমিটি আছে। চীনে সেখানকার সবরকমের নাম ফলকগুলো চীনা ভাষায় লেখা হয়। সংখ্যাগুলো ইংরেজিতে দেয়। আমাদের এখানে রাস্তাঘাট আর বাজারে দেখেন নাম ফলক এর কি হাল! চীন, জাপান, কোরিয়ায় বাইরের শিক্ষার্থীরা পড়তে গেলে তাকে প্রথমে ঐ দেশের ভাষা শিক্ষা দেয়া হয় বাধ্যতামূলকভাবে। ইংরেজি বা আন্তর্জাতিক যে ভাষায় আপনি শিক্ষা গ্রহণ করুন, আপনাকে আগে সে দেশের ভাষা শিখতেই হবে। এর নাম মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, এর নাম দেশপ্রেম।

আমাদের সংবিধানের প্রথম ভাগের চার নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ এর মানে সংবিধান যেদিন প্রণিত হলো, সেদিন থেকেই এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেখা যায়, রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে বাংলার ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু এর উল্টো দিকে অন্ধকারও আছে। ১৯৮৭ সালে দেশে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন হয়েছে। আইন করার পরে যে সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হয়েছে, সেটা বলতে পারি না। উচ্চ আদালতে বাংলা চালু হয়নি, যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবে। সেখানে আইনি পরিভাষার দোহাই দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েকজন মাননীয় বিচারপতি বাংলা ভাষায় রায় দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, বাংলা ভাষায় রায় দেওয়া যায়। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও জটিলতা থেকে গেছে। যেখানে আমরা বাংলার প্রচলন করতে পারিনি। স্নাতক পর্যায়ে; বিশেষত যারা সম্মানে (অনার্স) পড়ে, এ দেশে তাদের পড়ার জন্য বাংলা বই পাওয়া আকাশ-কুসুম কল্পনাই। বেশিরভাগই ইংরেজি পড়ে, অল্প কয়েকে ভারতীয় বাংলা বই খোঁজে বের করে। অনেকেই যুক্তি দিবেন, সব কিছুর বাংলা অনুবাদ হতে পারে না। সব কিছুর না হোক, যা করা যায় তাই তো নাই। এডাম স্মিথ'র কোন বইয়ের বাংলা অনুবাদ কি আমাদের অর্থশাস্ত্রের শ্রেণি কক্ষে পড়ানো হয়? অনুবাদই হয়নি, পড়ানো হবে কেমনে? এ বই অনুবাদ করার মানুষ কি আমাদের নেই? নিজেরা কি লিখি না, না-কি লিখার যোগ্যতা নাই -এ প্রশ্ন করা খুব বেশি অন্যায় হবে মনে করি না। এটি একটি উদাহরণ মাত্র। এ দশা সর্বত্রই।

রাষ্ট্রের একটা ভাষানীতি এবং ভাষা–পরিকল্পনা থাকা খুব দরকার। আর তা দরকার একটি ভবিষ্যৎ-মুখী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আমাদের এসব হয়নি। হ্যাঁ, অন্য ভাষা শিখতে হবে। কিন্তু সেটা আমাদের বাংলা ভাষা বাদ দিয়ে তো নয়। অন্য ভাষাটা শিখতে হবে প্রয়োজনে, বাংলাটা চর্চা করতে হবে আবশ্যিকভাবে, বাঁচার তাগিদে, বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় সমস্যা আছে, আমরা যদি এই প্রশ্নগুলো তুলতে পারি, সেসব সমস্যা মেটাতে আমরা কিভাবে এগোতে পারি—এই আলোচনাটা করা আজ খুব বেশি প্রয়োজন।

ভাষা সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতার বিষয়টা নিয়ে সবার কথা বলতে হবে। আজকাল আমাদের দেশে যত অনুষ্ঠান হয়, যেমন- বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত, গায়েহলুদ—সব আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে লেখা হয় এবং সেটা শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত–নির্বিশেষে। এখন এর জন্য আমরা কাকে দায়ি করবো? আমাদের ফুটবল আর ক্রিকেট দলের নাম কেন ইংরেজিতে দিচ্ছি? ব্যাংক সমূহের মধ্যে ক'টির নাম বাংলায় আছে? এ সবের তো সহজ আর উত্তম সুন্দর বিকল্প বাংলাতে আছেই। এর ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্টরা দিতে পারবেন?

১৯৪০ সাল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সব মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করে দেওয়া হয়। কিন্তু তখনো উচ্চ মাধ্যমিক আর তার পরের অন্যান্য ধাপে ইংরেজি মাধ্যম প্রচলিত ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ইংরেজি মাধ্যম ছিলই। কিন্তু সে অবস্থায়ও আমরা দেখেছি, সেকালে সব বিয়ের আমন্ত্রণপত্র বাংলায় লেখা হতো এবং বিয়ে উৎসবে একটা বাংলা কবিতা পাঠ করা হতো। দ্বিতীয়ত, এই যে আমরা রোমান হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে এত আন্দোলন করেছি পাকিস্তানি জমানায়, এখন আমাদের সন্তানেরাই রোমান হরফে বাংলা লিখছে। কোন বাংলা লিখছে—আঞ্চলিক বাংলা।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের বয়স অনেক লম্বা হয়ে গেছে, কিন্তু বাংলা ভাষার এমন দুর্গতি এখনও বিতাড়ন করা যায়নি। শিক্ষকেরা যখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেন, বেশিরভাগই তখন প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। কথা হচ্ছে, যে ভাষার আঞ্চলিক রূপ আছে, প্রমিত রূপ আছে। যেখানে প্রমিত দরকার, সেখানে প্রমিত ব্যবহার করবো, যেখানে আঞ্চলিক দরকার, সেখানে আঞ্চলিক ব্যবহার করবো। কারণ, আঞ্চলিক ভাষাও আমাদের ভাষা। সমস্যাটা হলো মিশ্রণ। বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকেই এ দায়িত্বভার নিতে হবে সর্বাগ্রে।

টেলিভিশন সমূহে নির্দিষ্ট বিরতিতে এক দিন ব্যান্ড সংগীত হয়। এতে তাঁরা বাংলা গান নিজেরাই ব্যবহার করেন, নিজেরাই সুর দেন। কিন্তু তাঁরা যখন কথা বলেন, অর্ধেক ইংরেজিতে, অর্ধেক বাংলায়। মনে হয় যেন তাঁদের মাতৃভাষাটা ইংরেজি, আর এখানে তাঁরা চেষ্টা করে, অনেক কষ্ট করে বাংলা বলছেন।

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে আগে ইংরেজি মাধ্যম ছিল। তখন একটা আন্দোলন হলো যে, যার খুশি সে বাংলায় পরিক্ষা দিতে পারবে। এটা তখন যারা নিয়ন্ত্রণকারি কর্তৃপক্ষক ছিল বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তাঁরা সেটা মেনে নিলেন। কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজিটা থেকে গেলো। তো, সে আমলে যদি এগুলো হয়ে থাকতে পারে, বাংলাদেশ আমলে কেন এগুলো হতে পারবে না? তার মানে, এখানে আমাদের মধ্যে সম্ভবত একটা হীনম্মন্যতা কাজ করছে। আমরা উচ্চতর আদালতকে দোষারোপ করি যে তাঁরা ওখানে বাংলায় রায় দিচ্ছেন না। শুধু রায় দিলে তো হবে না, আমাদের উকিল সাহেবরা কি বাংলায় সওয়াল–জবাব করবেন? আইনের শিক্ষার্থীরা কি বাংলা ভাষায় তার পাঠ্য বই পড়ে মনের তৃপ্তি মিটাতে পারবেন? বাজারে এসব রস আছে কি?

কেনো আমাদের বাড়ির নাম, দোকানের নাম ফলক বাংলায় লিখতে বলতে হবে? কেনো আমাদের বিভিন্ন উৎসব–অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বাংলায় লিখতে বলতে হবে? তাহলে এই স্বাধীনতার অর্থ কোথায়? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায়? এর একটাই উত্তর—সপ্তদশ শতকে আব্দুল হাকিম বলে গেছেন, "যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী, সে সবে কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি"। হ্যাঁ, যদি তাঁরা বাংলা ব্যবহার করতে দ্বিধাজড়িত থাকেন।

আমাদের প্রকৃত সদিচ্ছার অভাব আছে—এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ হচ্ছে, তথাকথিত অতি আধুনিকতা ও বহির্বিশ্বের প্রভাব। আমাদের একটি ভাষানীতি প্রয়োজন। আমাদের কোনো ভাষা–পরিকল্পনা নেই। তাও লাগবে। ভাষা–পরিকল্পনার দুটো দিক থাকে। একটা হচ্ছে অবয়ব–পরিকল্পনা, আরেকটা মর্যাদা–পরিকল্পনা। তা এই মর্যাদার জায়গাটি আমরা এখনও স্থির করতে পারিনি। মর্যাদা এবং কার্যকারিতার মানসিকতাটা এখনো তৈরি হয়নি কোনদিক থেকেই।

‘বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ নিয়ে একটা কাজ করছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। এই কাজে তিনি একসময় অনেকের সহযোগিতা চাইলেন। সেখানে দেখা যায়, নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে আসলে বাংলা ভাষা পুরোটা কার্যকর করা সম্ভব নয়। এবং প্রয়োজনও নাকি নেই। আশ্চর্য ব্যাপার, এই দীর্ঘদিনেও সেই একই মানসিকতা রয়ে গেছে।

আজ আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন, সে আপনাকে বলবে, প্রযুক্তি ও প্রয়োগগত বাধা আছে। তারপর বলবে, সহায়–সংস্থান এবং সময়–সুযোগের অভাব আছে। আমি বলবো, আসলে আবেগ ত্যাগ এবং বাস্তবতা গ্রহণের সমস্যা আছে। মানসিক সমস্যা, দাসত্ববোধ আর চৌর্যবৃত্তি দোষ তো আছেই।

বাংলা ভাষা লেখার জন্য এখন একাধিক সুন্দর ও আধুনিক প্রযুক্তি মাধ্যম রয়েছে। একটু চেষ্টা করলেই সেটা ব্যবহার করা যায়। যাঁরা কম্পিউটার ব্যবহার করেন, তাঁরা জানেন যে ইন্টারফেসের একটা ব্যাপার থাকে। একটা আস্কিতে চলে, আরেকটা ইউনিকোডে চলে। এখন ইউনিকোড আমাদের বাংলা ভাষার সবগুলো নিয়ে নিয়েছে। প্রয়োগ ও প্রযুক্তি আসলে আমার কাছে এখন আর কোনো সমস্যা বলে মনে হয় না।

সর্বস্তর বাংলার ব্যবহার বলতে আমরা কী বুঝি আসলে। এখন পর্যন্ত আমাদের ধ্যান-ধারণা বা চিন্তাচেতনা প্রশাসন, প্রতিষ্ঠান—এগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। আমরা কি জনমানুষ নিয়ে চিন্তা করি? যে দেশে এখনো ২৫ শতাংশেরর কাছাকাছি মানুষ লেখাপড়া জানে না, সেখানে প্রমিত বাংলার চর্চা কীভাবে হবে? সর্বস্তরের কথা বললে আমাদের এ বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবতেই হবে।

বেতার যে ভূমিকাটা পালন করে, বিশেষ করে বিশেষ তরঙ্গ বেতার। সেখানে ভাষার চরম বিকৃতি হচ্ছে। মোবাইল সেটের মধ্য দিয়ে যে খুদে বার্তাগুলো আসছে, রোমান হরফে ইংরেজিতে বাংলা লেখা জগাখিচুড়ির একটা চূড়ান্ত রূপ। বাংলাদেশে লাখ লাখ কৃষক। আমরা কিন্তু কখনো দেখি না, কৃষি উপকরণে যে ভাষাটা ব্যবহার করা হয়, সার ইত্যাদির ব্যবহারবিধিটা ইংরেজিতে বেশির ভাগ এবং বাংলাটাও কঠিনভাবে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষানীতি তো বলেছিল ইংরেজি মাধ্যম অথবা ধর্মীয় মাধ্যমে ন্যূনতম পাঁচটি ভিন্ন বিষয় নিয়ে পাঠ্যপুস্তক পড়তে হবে। সেসবে বাংলা ভাষার কথা বলা হয়েছে। সেগুলোতে কঠোর তদারকি দরকার।

আমরা কাদের কাছে নতিস্বীকার করছি? প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে। এ রকম যদি চলে, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক হলি আর্টিজান প্রকৃতির ঘটনা মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
১৯৭৩, ১৯৭৫, ১৯৭৯ সালসহ বিভিন্ন সময়ে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ১৯৮৪ সালে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ ১৯ টি প্রকল্প চালু করে। এর মধ্যে ১৮ নম্বর কার্যক্রমটি ছিল বাংলাদেশের সব কার্যালয়ের নাম ফলক ও কর্মকর্তাদের নাম ফলক বাংলায় লিখতে হবে। নথিপত্রে বাংলায় লেখার সঙ্গে সঙ্গে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর করতে হবে। আমরা যদি ওপরের দিকে তাকাই—মহামান্য রাষ্ট্রপতি আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলায় স্বাক্ষর করেন। এই সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। বেশিরভাগই স্বাক্ষরটি ইংরেজিতে করেন। এটি বাংলায় করতে অসুবিধা কোথায়? মাতৃভাষার প্রতি দরদ বাড়লেই এটি হবে। এটি করতে হবে।

২০১২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটা পরিপত্র জারি করে সরকার যে, আমরা বানানে সমরূপতা ও সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করবো। ২০১৫ সালে ‘সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা’ নামের একটি পুস্তিকা প্রণয়ন করা হয়। ২০১৬ সালে প্রশাসনিক পরিভাষা, পদবির পরিভাষার বই হয়েছে। সরকারি কাজে প্রমিত বাংলা ব্যবহারের নিয়ম এবং সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলার দ্বিতীয় সংস্করণ নামক দু'টি পুস্তিকা প্রণিত হয়েছে। এসব খোঁজ করতে হবে আমাদের নিজেদের স্বার্থে, এটি আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।

আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে। আমরা যদি জানার বিষয়টাকে পোক্ত করতে না পারি, তাহলে প্রয়োগের বিষয়টা হবে না। যারা জানবে, তারাই প্রয়োগ করতে পারবে, তাদেরকেই প্রয়োগ করতে হবে। আর জানার পুরো বিষয়টাকে আনন্দদায়ক করে তুলতে হবে। আমরা অনুজদের প্রায়ই বলি, তোমাদের আধুনিক হতে হবে অর্থাৎ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। ইংরেজি জানাটাই আধুনিক হওয়া বা যুগের সাথে তাল মিলানো নয়। বাংলা না–জানাটা আধুনিক না হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। যাঁরা মনে করেন বাংলা জানাটা ইংরেজি জানার সঙ্গে পরস্পরবিরোধী, তাঁদের ভাবনাটা ঠিক নয়; আমি বলবো, শুদ্ধ বাংলা জানা বা চর্চা বরং ইংরেজি প্রয়োগ করার ব্যাপারে সুবিধা হয়, যদি বাংলা ভালোভাবে জানা যায়। একটা অনুরাগ জন্ম দেওয়ার ব্যাপার। এটা আসলে আমাদের সবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একটা হচ্ছে বিদ্যালয়, আরেকটা হচ্ছে বিদ্যালয়ের বাইরে। এই যে ভাষা প্রতিযোগের আয়োজন, বিদ্যালয়ের বাইরে এ রকম কোনো উদ্যোগ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা যায় কি-না। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এতোটুকুই বলবো, প্রচণ্ড রকম একটা অনুরাগ এবং ভালোবাসা সৃষ্টি করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের সকলেরই।

শহীদ কাদরীর নির্বাসনের একটা কবিতা পড়ছিলাম একদিন সকালে-
‘পুকুরের যৌথস্নান থেকে নিঃসঙ্গ বাথরুম নির্বাসন কাম্য নয়’।
আমরা এখন অনেকটাই নিঃসঙ্গ। আমাদের ছেলেমেয়েদের আমরা এই নিঃসঙ্গতায় না পাঠিয়ে তাদের উৎসাহ দিতে পারি যে, বাংলা ভাষা জানা দরকার, এটা জানলে তোমরা অনেক আধুনিক হতে পারবে। তোমাদেরই এটি গর্বের বিষয়।

ভাষা প্রতিযোগ বিষয়টা যেহেতু বিদ্যালয়ের পর্যায়ে হয়, সেটির আলোকেই এই কথা বলতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সচেতনতার বিপর্যয় আমাদের প্রবলভাবে গ্রাস করেছে।
১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতির জনক বাংলা একাডেমিতে বক্তৃতা করেন। সেটি পর্যালোচনা করলে দেখি- তিনি বলছেন, ‘ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমি ঘোষণা করছি, আমার দল ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকেই সকল সরকারি কার্যালয়, আদালত ও জাতীয় জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বাংলা চালু করবে। এ ব্যাপারে আমরা পরিভাষা সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করবো না। কারণ, তাহলে সর্বক্ষেত্রে কোনো দিনই বাংলা চালু করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় হয়তো কিছু কিছু ভুল হবে। কিন্তু তাতে কিছু যায়–আসে না। এভাবেই অগ্রসর হতে হবে।’ শেষে তিনি ভাষা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মুক্ত পরিবেশেই ভাষার বিকাশ হয়। ঘরে বসে ভাষার পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা যায় না। এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন হয় ব্যবহারের ভিতর দিয়ে। ভাষার গতি নদীর স্রোতধারার মতো। ভাষা নিজেই তার গতিপথ রচনা করে নেয়। কেউ এর গতি রোধ করতে পারে না...।’

আমাদের কিছু মৌলিক গলদ থেকে গেছে। বাংলা বা বাংলা ভাষা নিয়ে যখন আলোচনা করি তখন সেখানে উপস্থিত সবাই বাংলার লোক থাকেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এখানে বাংলার চর্চাটা জোরদার হচ্ছে না। অন্যরা মনে করেন, এটা বাংলার ব্যাপার। আসলে এটা বাংলার ব্যাপার নয়। আমরা উনিশ বা বিশ শতকের বাংলা চর্চার যে প্রশংসা করি, সেটার মধ্যে একটা ব্যাপার উল্লেখই করি না। সেটা হচ্ছে যে, উনিশ ও বিশ শতকের গোড়ায় বাংলাকে আসলে সাহিত্যের ভাষা হিসেবেই দেখা হয়েছে। এবং ঔপনিবেশিক বাস্তবতায় তাঁরা সেটা করতে বাধ্য ছিলেন। কারণ, তাঁদের রাষ্ট্র চালানোর ও রাজনীতি করার ক্ষমতা ছিল না। ওই যে সাহিত্যেই বাংলা ব্যবহৃত হবে, এই চিন্তাটাই আমাদের মধ্যে এখনও অত্যন্ত প্রবল। এটা আমাদের অন্য অনেক সমস্যার গোড়ায় গভীরভাবে কাজ করছে।

পরিভাষা নিয়েও আমাদের চিন্তা অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন। পরিভাষা করার ক্ষেত্রে বাংলার শিক্ষকের কোনো সম্পর্ক নেই। পরিভাষা একটা চর্চার বিষয় এবং যে বিষয়ে চর্চা করছে, তার ভেতর দিয়ে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরিভাষা তৈরি হতে পারে। আমাদের এখানে একেবারেই উল্টো কথা চালু আছে। বাংলা একাডেমির এ ব্যাপারে বহু কাজ ও দায়িত্ব। সংস্কৃতায়িত শব্দে বাংলা পরিভাষাগুলো ভরিয়ে তুলেছে। এবং সেটা কেউ ব্যবহার করে না। পরিভাষার যোগ বাংলা ভাষার সঙ্গে নয়, বিষয়ের সঙ্গে।

আমাদের প্রমিত বাংলা সাংঘাতিক রকমের জনবিরোধী। কৃষকদের উপযোগী এক অনুচ্ছেদের বর্ণনা তৈরির করার ক্ষমতা আমরা যারা প্রমিত বাংলা চর্চা করি, তারা হারিয়েছি। আমাদের ভাষা আসলেই জনবিচ্ছিন্ন হয়েছে। আমরা এখন কার কাছে বাংলা ভাষা চাই? আমরা চাইলেই তো বাংলা চালু করতে পারি। করি না কেন? এতে আমার ধারণা, আমাদের অনেকে একটা হীনম্মন্যতা আছে। এবং প্রতারণামূলক একটা ব্যাপার আছে। আমাদের অনেকের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে। এটা নিয়ে কথাবার্তা কম হয়।
অপর দিকে ছেলেমেয়েরা বাংলা–ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে, ওরা একটা ব্যবস্থার ফল মাত্র। ওদের সমালোচনা করে তো লাভ নেই, সুযোগও নেই। আমরা আমাদের ব্যবস্থার প্রায় সম্পূর্ণই ইংরেজির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কোনোভাবে ক্ষমতা আছে, সমাজের এমন একটা অংশও বাংলায় পড়াশোনা করে না। বাংলার সমস্যাটা দেশে একটা কাঠামোগত সমস্যা। ওই কাঠামো প্রধানত নির্ভর করে ব্যবস্থার ওপর। বাদবাকি আমরা যে আবেগ প্রকাশ করছি, আমি সেটাকে একটা প্রতারণামূলক অবস্থান বলব!

আমরা প্রায় সময় বাংলার পক্ষে যুক্তি দিই আবেগ দিয়ে। আর ইংরেজি সব সময় বাজার আর প্রয়োজনের কথা বলে। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন করতে হবে রাষ্ট্রের জন্য। আপনি যদি উন্নতি চান, আপনি যতি জ্ঞান-বিজ্ঞানেরর চর্চা চান-এটা হতেই হবে। আপনি যদি উন্নতি চান, ১৬ কোটি মানুষ নিয়ে উন্নতি করবেন, তাহলে আপনার বাংলা লাগবেই। আপনি যদি সত্যি সত্যি শিক্ষা চান, বাংলা লাগবেই। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে উচ্চ শিক্ষায় বাংলাকে অবশ্যই আবশ্যিক করতে হবে। আপনি যদি বিদেশে স্থায়ি হতে চান, সে জন্য আপনি ইংরেজি পড়তে পারেন। আপনি বিশ্ববাজারে শ্রমিকগিরি করবেন, ইংরেজি পড়তে পারেন। কিন্তু আপনি যদি ব্যবসা বোঝান, আপনি যদি শিক্ষা বোঝান, আপনাকে অবশ্যই ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত—সর্বস্তরে বাংলায় করতে হবে। প্রয়োজনকেই সামনে নিয়ে আসতে হবে এবং এটি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

প্রতিবছরই আমরা দেখি বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে ঈদের সময়ে আমাদের টেলিভিশনগুলো অনেক নাটক প্রচার করে। সেগুলোর বিজ্ঞাপন বের হয়। এই বিজ্ঞাপনগুলো যদি আপনি দেখেন, শতকরা নব্বই ভাগ পণ্যের নামই ইংরেজিতে, অল্প আছে অন্য ভাষায়। টিভি'র নাটকের মধ্যে শতকরা প্রায় সত্তর ভাগ নাটকের নাম ইংরেজিতে। আমাদের আলু ভর্তা, ডাল–ভাত বাদে প্রায় সব খাবারের দোকানের নামই ইংরেজিতে।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিমান ও প্রযুক্তি, উচ্চশিক্ষার কিছু ক্ষেত্র বাদে বাকি জায়গাগুলোতে বাংলা ভাষা প্রয়োগের সুযোগের পরিমাণ অবারিত। আমার তো মনে হয়, আমরা সবাই একটু আন্তরিক হলেই, একটু উদ্যোগ নিলেই সবই সম্ভব। বিদেশ থেকে শুধু মোবাইল নয়, অন্য পণ্য যারা বিক্রি করে বা ব্যবসা করে বাংলাদেশে, তাদের আমরা বাধ্য করতে পারি যে পণ্যগুলোর নাম বাংলায় আসবে। সেটা সম্ভব। আসলে সমস্যাটা অন্য জায়গায়। চানাচুর ভাজা বাদ দিলে, অন্যসব রোমান হরফে চলে গেছে, যত পণ্য আছে তার সবই ইংরেজি নামে চলে আসছে। ১৯৮৪ সালে যখন সামরিক সরকার ক্ষমতায়, সেই সময় নির্বাহী আদেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে সব প্রতিষ্ঠানের নাম ফলক ও গাড়ির নাম ও ক্রমিক ফলক বাংলায় হতে হবে। এবং যদি প্রয়োজন মনে করেন, নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লেখা যেতে পারে। এই আইন করে দেওয়া আছে। আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। কেউ মেনে চলি না। অথচ এটি রাষ্ট্রের পবিত্র আদেশ। আমরা মাতৃভূমি প্রেমিক নই বলেই এটি হচ্ছে!

সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে, যাতে করে আমরা ভাবতে পারি, বিয়ের চিঠি বা সন্তানের জন্মদিনের চিঠি বাংলায় হলে মানুষ তা গ্রহণ করবে। গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা খুবই প্রয়োজন। শিক্ষার প্রসঙ্গটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রমিত বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাষা–পরিকল্পনাও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমাদের শিক্ষানীতি আছে, আমরা কি একটা ভাষানীতি করতে পারি না? এই জিনিসগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাবতে হবে।

ইংরেজি শিখলে লাভ—সে জন্যই আমাদের সন্তানেরা ইংরেজি শিখতে চায়। বাংলা শিখলে কি কি লাভ, কোথায় কোথায় সে সুবিধা পাবে—এ কথাটা আমরা যদি স্পষ্ট করে বলতে পারি, তাহলে আর আইন করতে হবে না। এমনিতেই বাংলা সর্বস্তরে প্রচিলত হবে। এটা সকলের কর্তব্য।

বাংলাদেশে বাংলা ভাষার অবস্থা এখন স্বদেশে পরবাসীর মতো। সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে যে, আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আমরা কেউ প্রজাতন্ত্রেরর বাইরে নই। অতএব, সর্বত্রই বাংলার ব্যবহার রাষ্ট্রের আদেশ। যদি তা না করি, বুঝতে হবে আপনি রাষ্ট্রের আদেশ মানেন না বা রাষ্ট্রের প্রতি আপনি শতভাগ অনুগত নন। অথচ এটি খুব প্রয়োজন। ১৯৭৮ সালে প্রচারিত সরকারি একটি পরিপত্রে বিজ্ঞাপিত হয়েছিল, ‘যদি সংবিধান–সংক্রান্ত কোনো গোঁজামিল দেখা দেয়, ব্যাখ্যার দরকার হয়, তাহলে ইংরেজি প্রাধান্য পাইবে।’ পরে তা সংশোধন করা হয়েছে। ‘সর্বস্তরের বাংলা প্রচলন হইবে’ ১৯৭৮ সালে যে পরিপত্রটি হয়েছিল, তা ইংরেজিতে। এই যে নতুন একটি ইংরেজি শিক্ষিত উঁচু শ্রেণির জন্ম হয়েছিল, সেটির ধারাবাহিকতা এখনো আছে। ভেতরে–ভেতরে এই জিনিসটি কাজ করেছে দীর্ঘদিন ধরে।

উচ্চ শিক্ষায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলা বিভাগ ছাড়া অন্য কোনো বিভাগের প্রশ্ন এখন বাংলায় করা হয় না বললে খুব বেশি বাড়িয়ে বলা হয় না। এতে সরকারি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো হেরফের নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীদের বলতে শুনেছি, অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের বলেন, বাংলায় লিখলে নম্বর পাবে না বা কম পাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছাড়া আর কোনো বিভাগের প্রাসঙ্গিক বই বাংলায় থাকে না। দু–একটি জায়গায় আছে। এটি ব্যতিক্রম।

১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে ১৮৩৫ থেকে ১৮৬৯ পর্যন্ত সব বক্তৃতা বাংলায় দেওয়া হতো। শিক্ষার্থীরাও বাংলায় লিখে পাস করতেন। যদি ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত বাংলায় চিকিৎসাশাস্ত্র পড়া যায়, এখন পারা যাবে না কেন? আমরা আঠারো শতকের শেষের দিকে অথবা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যাই, জোনাথান ডানকান অথবা ফস্টার সব আইন বাংলায় অনুবাদ করিয়েছেন মুনশিদের দিয়ে। যদি ২০০ বছর আগে বাংলা ভাষায় আইন করতে পারে ব্রিটিশরা, তাহলে আজ বাংলায় করা যাবে না কেনো? আসলে আমাদের সদিচ্ছার অভাব আছে কি-না তা চিন্তা করার সময় হয়েছে সম্ভবত। আর এটি সম্ভবত মানসিক সদিচ্ছার অভাব।

বাংলা ভাষা পুঁজিবাদের শিকার। হ্যাঁ, কর্মক্ষেত্রের প্রয়োজনে আমরা ইংরেজি শিখবো। কিন্তু মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করে কখনোই অন্য ভাষা ভালো করে শেখা যায় না, উচিত তো নয়ই। উদ্ভট এক সংস্কৃতির মধ্যে আমরা পড়েছি। এই জায়গা থেকেই জনবিচ্ছিন্ন ভাষা হয়ে গেছে বাংলা। লোকায়ত মানুষের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং লোকভাষাটাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই জায়গা থেকে যদি দাঁড়াতে হয়, তাহলে সর্বস্তরের বাংলা ভাষা বাস্তবায়নের জন্য একটি কমিটি ও স্পষ্ট ভাষানীতি থাকা দরকার। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, বানানের কথা বলো? বানান যদি ঠিক করতে হয়, তাহলে কামাল পাশার মতো একজন শাসক দরকার। অনুমান করি, রবীন্দ্রনাথ কামাল পাশা বলতে একজন রাষ্ট্রীয় প্রশাসককে বুঝিয়েছেন। একটা আদেশ জারি হোক, এক মাসের জন্য দোকানের নাম বড় বাংলার নিচে ইংরেজিতেও একটু থাকতে পারে ছোট করে। নতুবা পাঁচ হাজার টাকার দণ্ড দিতে হবে। বাংলা একাডেমির কিছু করা লাগবে বলে মনে হয় না। এক মাসেই সব বানান ঠিক হয়ে যাবে। এটা স্থানীয় প্রশাসন করতে পারে। অত্যাচার, উৎপীড়ন, বাধা, অন্য হরফে লেখা এগুলো থাকবেই, কিন্তু এর মধ্য থেকে যুদ্ধ করেই বাংলা ভাষাকে টিকে থাকতে হবে। টিকিয়ে রাখতে হবে।

সবকিছুই বাংলা একাডেমি দেখবে না, দেখার দরকারও নাই। আমাদের প্রত্যেককেই দায়িত্বটা নিতে হবে। সর্বস্তরের কথাটার ব্যাখ্যাও বুঝতে হবে। সর্বস্তর মানে প্রশাসন, আইন–আদালত, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসা, প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য, প্রকৌশল এবং আনুষ্ঠানিক সভা–সমিতি। জার্মানের বিখ্যাত এক পণ্ডিত বাংলাদেশে এসেছিলেন কৃষি নিয়ে কাজ করতে, অভিভূত হয়েছিলেন। কৃষকদের শব্দ তৈরি করতে কোনো কষ্ট হয় না, নানা শব্দ তাঁরা তৈরি করেন। তিনি দেখালেন যে নদীর একটা জায়গায় কোণ হয়ে গেছে। তিনি বলছেন, ‘আমি তো জানি না ইংরেজিতে এই শব্দ কী হবে।’ তখন একজন কৃষক বললেন, ‘এটা স্যার, গাঙ্গের ঠেস।’ এটাকে প্রমিত করার দরকার নেই। সব লোক কখনো প্রমিত বাংলায় কথা বলবে না। প্রমিত বাংলা ব্যবহৃত হবে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে।

রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে এই বিশেষ ক্ষেত্রগুলোতে প্রমিত বাংলার প্রয়োগ নিশ্চিত হতে পারে। করণীয় এসব ক্ষেত্র সরকারি দপ্তরের অন্তর্ভুক্ত। অতএব, যদি আমরা সবাই সুস্পষ্টভাবে চাই তো এটা হতে পারে। না চাইলে হবে না। আমি অনুমান করি, জাতির জনক থাকলে এটা এতো দিনে হয়ে যেতো। আমার অনুমান করার কারণ বিশদ। আমরা এটা করতে পারছি না। তার কারণ, সম্ভবত এই জায়গায় নানা রকমের লাভ–ক্ষতির সম্পর্ক আছে। তা-ই যদি না হয় তো করছি না কেনো?

আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যতটুকু বুঝেছি, বাংলা ভাষা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা মগদের। আরাকান রাষ্ট্র ও বাংলা সাহিত্য হয়েছে মগের অঞ্চল। মগ বলতে যাদের বোঝানো হয়েছে, মগধ্ থেকে আসা। এটা নিয়ে ভিন্নমত থাকতে পারে। মগ, চট্টগ্রাম, সন্দ্বীপ—এসব অঞ্চলের লোকেরা বাংলা ভাষাকে যদি না–ই ভালোবাসতো, তাহলে বাংলা ভাষা টিকে থাকত কি-না তা সন্দেহ আছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যচর্চা, মধ্যযুগের ওই অঞ্চলের লোকেরা করেছে। ষোড়শ শতাব্দীতে সৈয়দ সুলতান, সপ্তদশ শতাব্দীতে আব্দুল হাকিমকে কেনো বলতে হয়েছিল, বাংলা ভূমিতে বাস করে যারা বাংলা চর্চা করে না, তারা জারজ সন্তান। তাতেই বুঝা যায়, বাংলাবিরোধিতা সব সময়ই ছিল এবং এখনো আছে। আমরা যারা নানা দায়িত্বে আছি, আমাদের দায়িত্বও অনেক। আমাদের সন্তানদের আমরা ইউরোপ, আমেরিকায় পড়াচ্ছি। তাদের কাছ থেকে আমরা আর কি আশা করতে পারবো!

লেখকঃ মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন, মহেশখালীর সন্তান ও পুলিশ কর্মকর্তা।