মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন
আমার শিশুকালেই দীপাবলীর সংগ্রামী জীবন আমাকে প্রভাবিত করেছিল। সেই থেকে বই পড়ার প্রতিও আমার আগ্রহটা বেড়েছিল। পরবর্তী সময়ে সমরেশের আরো বই পড়া হয়েছে। কিন্তু, আমার কাছে সাতকাহন আলাদাই। সমরেশই আমার ভিতরে আলাদা করে পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। পরে যদিও ধরে রাখতে পারেননি।
সমরেশ দেহ ত্যাগ করেছেন। সাতকাহন নিয়ে সামান্য হলেও আলোচনা না লিখলে অকৃতজ্ঞা হবে।
সাতকাহনের সাত কথা-
উপন্যাসটি মূলত একটি নারী কেন্দ্রীক গল্প। বাংলা সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য উপন্যাসের তালিকা করলে সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসটির নাম অবশ্যই যুক্ত করতে হয়। এটি শুধু একটি উপন্যাস নয়, একটি নারীর জাগরণের গল্প। অনেকেই এই বইটিকে সমরেশ মজুমদারের লেখা মাস্টারপিস বই বলে অভিহিত করেন।
শুরুতে বইটি দুটি খণ্ডে প্রকাশিত হলেও পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে অখণ্ড উপন্যাসটি প্রকাশ করে আনন্দ প্রকাশনী। এই গল্প অবলম্বনে বাংলাদেশ এবং ভারতে বিভিন্ন সময় নাটক, সিরিয়াল হয়েছে। এই বইটি প্রতিটি মেয়ের জন্য অবশ্যপাঠ্যও বলা যায়।
সাতকাহন উপন্যাসটিতে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি প্রকাশ পেয়েছে নারীবাদী চেতনা। প্রোটাগনিস্ট দীপাবলি জলপাইগুড়ির চা বাগানে বড় হওয়া এক কিশোরী, যার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতের গল্প এই সাতকাহন। আপোষহীন-সংগ্রামী এই নারী চরিত্র নিঃসন্দেহে সমরেশ মজুমদারের অন্যতম সেরা সৃষ্টি। পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধার গল্প। যে গল্প হাজারও মেয়ের জীবনকে বাঁচতে শেখায়। শুধুমাত্র বেঁচে থাকা নয়, নারীশিক্ষার বিষয়টিও গুরুত্বের সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে উপন্যাসে। দুই খণ্ডের বিশাল উপন্যাসটি পড়তে পাঠকদের কখনওই একঘেয়েমি লাগবে না। কারণ, তারা কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই দীপার জীবনের সাথে পরিচিতি অনুভব করবেন।
দীপাবলীর দ্বীপ ছটা-
শুধুমাত্র উপন্যাসের নায়িকা, নাকি বাস্তব জগতে এই মেয়ের কোনো অস্তিত্ব আছে? একটা জীবনের কাহিনী এতো সুন্দরভাবে চিত্রিত করা বাংলা সাহিত্যে বিরল। এই দীপাবলি কি শুধুমাত্র লেখকের কল্পনা? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে লেখককে অবশ্যই জানতে হবে। বাংলা লেখক হিশেবে সমরেশ মজুমদারের জুড়ি মেলা ভার। সাতকাহন থেকে শুরু করে তার প্রায় সব লেখায় সহজ-সরল ভাষায় খুব স্বাভাবিকভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন জীবনের সব স্তরের চিত্র। লেখককে একবার প্রশ্ন করা হয়, “আপনি কি দীপাবলিকে কাছ থেকে চেনেন?” খুব ছোট্ট সাদামাটা উত্তর, “হ্যাঁ, আমি যেখানে থাকতাম, সে পাড়াতে দীপাবলি থাকত, আমার প্রতিবেশী ছিল।” পুরুষতো বটেই, একজন নারী হিসেবে আপনাকে এই মেয়ের নারী হয়ে উঠার উপাখ্যান অবশ্যই পড়তে হবে। আর পুরুষ হিশেবে আপনি যদি এই উপন্যাস পাঠ করেন, তবে অবশ্যই বলতে হবে, নারীকে অসম্মান করার আগে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য হবেন।
তখন বাংলা ১৩৯৭ সাল, লেখকের শৈশব কাটে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ার্সের চা বাগানে। হয়তো সেখানেই সাক্ষাৎ মেলে এই দীপাবলি চরিত্রের সাথে। কারণ, সাতকাহনে দেখতে পাওয়া যায় চা বাগানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব সুন্দর বর্ণনা। সেখানে বেড়ে উঠছে এক দুরন্তপনা বালিকা। চা বাগানের সহজ-সরল জীবিকা এই উপন্যাসের অন্যতম উপজীব্য বিষয়। অধিকাংশ পাঠক এড়িয়ে যান যে বিষয়টি তা হলো উপন্যাসের বর্ণিত এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগর গড়ে ওঠার কারণ এবং সাথে সাথে জীবিকার পরিবর্তন। দীপাবলির কঠিন হয়ে ওঠার সাথে সাথে চারপাশের পরিবেশটাও কেমন যেন কঠিন হয়ে উঠেছে, এই বিষয়টা দীপাবলি চরিত্রের আড়ালে মলিন হয়ে থাকে। কেননা উপন্যাসের শেষে সহজ সরল দীপাবলির পরিবর্তে এক কঠিন দীপাবলিকে চোখে পড়ে।
সমাজের অনেক পিছিয়ে পড়া অবস্থা থেকে একজন মেয়ের উপরে উঠে আসার গল্পই মূলত সাতকাহন। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই দীপাকে অতিক্রম করতে হয়েছে নানা বাধা-বিপত্তি, মুখোমুখি হতে হয় কিছু অপ্রিয় সত্যের। চেনা জগতটা চটজলদি অচেনা হয়ে যায় দীপার। কিন্তু তবুও সে থেমে থাকেনি। নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছে নিজের সম্মান প্রতিষ্ঠার। নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে অর্জন করেছে সাফল্য কিন্তু সাফল্য অর্জনের এই পথ মোটেও সহজ ছিল না তার জন্য। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়েছে সমাজ, পরিবার, এমনকি মাঝে মাঝে নিজের সাথেও। একজন নারী যে পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম না, তা দীপাবলি বুঝিয়ে দিয়েছে চোখে আঙুল দিয়ে।
দীপাবলী ছাড়াও আরো অনেকগুলো নারী চরিত্র এসেছে উপন্যাসটিতে। দীপাবলীর ঠাকুমা মনোরমা সেকালের মানুষ হয়েও অনেকের চেয়ে আধুনিক। চা বাগানকে ঘিরে যাদের জীবিকা, তাদের জীবন সম্পর্কে চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় বইটিতে। বর্ণনাগুলো এতই নিখুঁত যে পড়ার সময় পাঠক চা বাগানে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ার ছবি দেখাটাও অদ্ভুত নয়। পঞ্চাশের দশকে ভারতে এমন অনেক জায়গা ছিল, যেখানে তখনও বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। এই উপন্যাসের চা বাগানটিও সে ধরনের একটি জায়গা যেখানে আধুনিক সভ্যতার পদচারণা সবে শুরু হয়েছে।
সমাজের ঘুণেধরা সংস্কারের বিরুদ্ধাচরণ করে সমাজে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে এক নারী। সাধারণের মাঝেই দীপাবলীর গল্প অসাধারণ। গল্পের শুরু থেকে শেষপর্যন্ত তার চরিত্রের বিকাশ এবং জীবনবোধের পরিবর্তন গল্পটিকে অন্য এক রূপ দিয়েছে। বাংলার প্রতিটি নারীই দীপাবলির মাঝে অল্প হলেও নিজেকে খুঁজে পাবে। কেউ হয়তো তার উপর হয়ে যাওয়া অন্যায়গুলোর শিকার, আবার কেউ হয়তো তার মতো অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পেরেছে। দীপার জীবনে এসে মিশেছে নানা নাটকীয়তা, আর এসব নাটকীয়তাকে ছাপিয়েই যার জীবন এগিয়ে গেছে। চরিত্রটি প্রবল স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। লোভ, ঘৃণা, প্রেম, রিপুর তাড়না, বাঁচার ইচ্ছে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা; সবমিলিয়েই সমরেশ মজুমদারের অমর সৃষ্টি দীপাবলী।
দীপাবলীকে যতই চেনা যায়, অবাক হতে হয়; কখনো বা তাকে মনে হয় অতি চেনা এক নারী। বিংশ শতাব্দীর নারীদের চিন্তা যে কতটা আধুনিক ছিল, তা এই উপন্যাস না পড়লে বুঝতে পারা যায় না। দীপাবলি, রমলা সেন আর মায়ার আধুনিকতা দেখে হয়তো বর্তমানের অনেকের চিন্তা-চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হয়।
উপন্যাস সংক্ষেপ-
উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র দীপাবলী, ডাকনাম দীপা। বাবার নাম অমরনাথ। জন্মের পরেই গর্ভধারিণী মাকে হারায় দীপা। পরবর্তী সময়ে সৎ মা আর দাদী মনোরমার পীড়াপীড়িতে মাত্র ১২ বছর বয়সে বিয়ে করতে বাধ্য হয় দীপা। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, বিয়ের পরের দিনই বিধবা হতে হয় দীপাকে। তাই বাধ্য হয়েই বাবার বাড়ি ফিরে আসে সে। আর পাঁচটা বাঙালি হিন্দু বিধবার মতোই জীবন কাটানোর কথা ছিল তার। কিন্তু নিয়তির কাছে হার না মেনে দীপা বেছে নিল স্রোতের প্রতিকূলের পথ।
নিজের জীবনকে নতুন করে গড়তে অজানার পথে যাত্রা শুরু করল সে। এক আত্মীয়ের সহায়তায় মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে ভর্তি হয় দীপা। শুরুতেই কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনার সুযোগ পায় সে। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুত্ব হয় শমিত, মায়া ও সুদীপের সঙ্গে। পড়াশোনার পাশাপাশি নাটকের দলে টুকটাক অভিনয়ও করে সে। নাটকের দলটি ছিল শমিতের।
শমিতের নাটকের দলে অভিনয়ের সুবাধে শমিতের বাড়িতে যাওয়া আসা ছিল দীপার। একদিন ভরদুপুরে দীপাকে জড়িয়ে ধরে প্রেমের প্রস্তাব দেয় শমিত। কিন্তু দীপা তা প্রত্যাখ্যান করে চলে আসে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মানুষের সাহায্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে দীপা। পশ্চিমবঙ্গের সিভিল সার্ভিসে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে সে। দীপার প্রথম কর্মস্থল ছিল নেখালি গ্রামে। প্রথমেই এলাকাগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে জনগণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সে। পরবর্তী সময়ে মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সময় সাহস করে নিজের এলাকার সমস্যার কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলে যায় সে। মন্ত্রীমশাই দীপার এই সাহসে মুগ্ধ হন এবং দীপার সঙ্গে উক্ত গ্রাম পরিদর্শনে আসেন৷
মন্ত্রীমশাই সমস্ত সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে যান। কিছুদিন পরেই শমিত এসে উপস্থিত হয় দীপার এলাকায়। ভালোবাসা না পাওয়ার রাগে পদে পদে দীপাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে সে। এক পর্যায়ে শমিতকে নিয়ে সারা গ্রামেই মুখরোচক গল্প প্রচারিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে শমিত খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং দীপা সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে শমিতকে সুস্থ করে তোলে। তখন শমিত দীপার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেখালি থেকে চলে যায়।
নেখালির স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতা হলেন অর্জুন নায়েক। এলাকার উন্নয়নের কথা বলে বলে তার দলবল দিয়ে নানারকম অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে বেড়ায়। কিন্তু তার এসব কর্মকাণ্ডে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দীপা। তাও শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবাজদের সাথে না পেরে চাকরিটা ছেড়েই দেয় সে। চাকরি ছাড়ার অবশ্য আরও একটি কারণ ছিল। দীপার ইচ্ছা ছিল ভারতের সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার। তাই স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কলকাতায় চলে যায় সে। কলকাতার এক রাস্তায় আবারও প্রিয় বান্ধবী মায়ার সঙ্গে দেখা হয় তার। স্বামী সুদীপকে নিয়ে কলকাতার একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করে মায়া।
পরবর্তী সময়ে মায়া তার মায়ের বাড়িতে দীপার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। এ বাড়িতে থেকেই দিনরাত এক করে, নাওয়া খাওয়া ভুলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়াশোনা করে নিজেকে তৈরি করে দীপা। তার ফাইনাল পরিক্ষার সিট পড়ে দিল্লীতে। দিল্লীতে পরিক্ষা দিতে গিয়ে হোস্টেল না পেয়ে পরেশ বাবু নামক এক ভদ্রলোকের বাড়িতে থাকে দীপা। দীপার ভদ্রতা, আচার-আচরণে খুব মুগ্ধ হয়ে পরেশ বাবুর স্ত্রী দীপাকে নিজের পুত্রবধূ করার প্রস্তাব দেন। পরিক্ষা শেষে বাড়ি ফেরার পথে দীপার সঙ্গী হয় পরেশ বাবুর ছেলে অলোক। এসময় টুকটাক কথাবার্তা হয় তাদের।
দীপার কঠোর পরিশ্রম, দিনরাত এক করে পড়াশোনা, আত্মত্যাগ এসব বৃথা যায়নি। অবশেষে ভারত সিভিল সার্ভিসে কাজ করার সুযোগ পেয়ে যায় সে এবং প্রশিক্ষণের জন্য ডাকা হয় তাকে। এ খুশির খবর জানাতে মায়ার মায়ের কাছে দীপা ছুটে যায় এবং জানতে পারে তার প্রিয় বান্ধবী মায়ার মৃত্যুর কথা। মুহূর্তের জন্য বিশাল এক ধাক্কা খায় দীপা।
পরক্ষণেই দীপা ভাবে প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগে একবার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে সে তার দাদী মনরোমাকে দেখে আসবে। মনোরমা দেবী সেখানে দীপার সৎ মা এবং সৎ ভাইদের সাথে থাকেন। সেখানে গিয়ে তার সৎ মা অঞ্জলীর অবস্থা দেখে খুবই ব্যথিত হয় দীপা। মাতাল ছেলের অত্যাচারে নাজেহাল অবস্থা হয়েছে অঞ্জলীর, অসুখে ঠিকমত চিকিৎসাও জুটছে না তার। অথচ একদিন এই মহিলার অত্যাচারেই দীপা নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। পরদিন সকালে বাড়ির সামনে হাঁটতে বের হলে ছোটবেলার বন্ধু খোকনের সাথে দেখা হয় তার। খোকনের কাছ থেকে এ সংসার সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে পারে সে।
দিল্লীতে প্রশিক্ষণ চলাকালীন বেশ কয়েকবার দীপার সাথে দেখা করতে আসে অলোক। এসময় তাদের মধ্যে প্রেম হয় এবং অলোকের সাথে বিয়ের ব্যাপারে দীপা সম্মতি জানায়। ভারত সিভিল সার্ভিসে কাস্টমস বিভাগে যোগদান করে দীপা, দিল্লীতে তার পোস্টিং হয়। দিল্লিতে গিয়ে অলোকের সাথে বিয়ে হয় তার। বিয়ের দিন আকস্মিকভাবে নাটকের কাজে দিল্লি আসে শমিত। দীপার অনুরোধে দীপার বিয়ের সাক্ষী হয় শমিত।
বিয়ের পর শুরুর দিকে ভালোই চলতে থাকে অলোক-দীপার সংসার। কিন্তু দিন দিন বিভিন্ন দিক থেকে পাল্টে যেতে থাকে অলোক। অতিরিক্ত মদ্যপান, আড্ডাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে সে। একবার অলোকের এক বন্ধু তার এক বেআইনি ফাইলের কাজ করে দিতে দীপাকে অনুরোধ করে। কিন্তু, দীপা এতে অসম্মতি জানায়। ফলে অলোকের ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়। সাংসারিক ছোট ছোট কারণে প্রায়ই মনমালিন্য হয় তাদের, দিনের পর দিন দীপার সাথে অশান্তি করতে থাকে অলোক। এদিকে অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেওয়ায় অফিসেও দীপার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তাই এক পর্যায়ে দীপা কলকাতায় নিজের বদলির জন্য আবেদন করে এবং অলোককে দিল্লীতে রেখে সে কলকাতায় চলে যায়।
কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে সেখানেই থাকা শুরু করে দীপা। এসময় অঞ্জলীর মৃত্যুর খবর পায় সে এবং তার দাদী মনরোমাকে নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়। কিছু দিন পরে অলোক কলকাতায় আসে দীপার সাথে দেখা করতে। সে দীপার কাছে মাফ চায় এবং দীপাকে তার জীবনে ফিরে আসতে বলে। কিন্তু দীপা সেদিন অলোককে প্রত্যাখ্যান করে ফিরে আসে। এসময় দীপা সিদ্ধান্ত নেয় সে আর সংসার পাতবে না, যেভাবে একা আছে সেভাবেই কাটিয়ে দিবে বাকিটা জীবন।
সেদিন দীপা তার নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে তার সেই বন্ধু খোকনকে দেখতে পায়। অসুস্থ মনোরমাকে নিয়ে দীপার কাছে এসেছে সে। দাদীকে পেয়ে দীপা খুব আনন্দিত হয় এবং সেবা দিয়ে দাদীকে সুস্থ্য করে তোলে। দাদীকে নিয়ে ছোট্ট একটা সংসার হয় তার। অফিস থেকে ফেরার পথে সে বাজার করে নিয়ে আসে, আর দাদী মহাআগ্রহে সেগুলো রান্না করেন। এসময় অনেক প্রাচীন কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসেন মনোরমা দেবী। সবশেষে দাদীকে নিয়েই বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দীপা।
অল্প বয়সে বিয়ের পর বিধবা হওয়া, কলেজ জীবনের বন্ধুত্ব, প্রেম, ব্যক্তিগত আবেগ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া, প্রিয় বান্ধবীর অকাল মৃত্যু, ২য় বার বিয়ে, বড় হয়ে নিজের এলাকায় ফিরে যাওয়া, অন্যায়ের সাথে আপস না করে সততার সাথে সিভিল সার্ভিসে কাজ করে যাওয়া এবং শেষের দিকে নিজের একাকিত্বের অবসান ঘটিয়ে বৃদ্ধা দাদির দায়িত্ব নেওয়া-সব মিলিয়ে এক অসাধারণ গল্প গাথা এই সাতকাহন।
দীপাবলীর এই কাহিনী দ্বারা তৎকালীন সমাজে গেড়ে বসা কুসংস্কারকে লেখক পরিষ্কার করে দিয়েছেন, সেইসাথে দেখিয়েছেন সেসময়ের নারী জাগরণ। দীপার মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন শুধু মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার জন্যই নারীর জন্ম হয়নি। নিজের মনের অন্ধকার দূর করলেই নারীরা এগিয়ে যেতে পারেন।