Advertisement


মনোদৈহিক আধিপত্যবাদ

জাহেদ সরওয়ার 


ক্ষিণ এশিয়ার বিগব্রাদার ইন্ডিয়ার চলচ্চিত্রের বাজার শুধু ইন্ডিয়ায় সীমাবদ্ধ নাই। শুধু চলচ্চিত্রের বাজারই বা বলি কেন, হেন কোনো বস্তু নাই যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যায় না। আর বাংলাদেশের কথা বললেতো প্রায় প্রত্যেক নিত্য ব্যবহার্য পণ্য থেকে শুরু করে সবধরণের ভোগ্যপণ্য এখন পাশাপাশি রাখা হয়। আপনি পেয়াজ কিনতে গেলেন? এইটা বাংলা এইটা ইন্ডিয়ান। কাপড় কিনতে গেলেন এইটা বাংলা এইটা ইন্ডিয়ান। এভাবে থালাবাসন, চালডাল, আলু, লুঙ্গি, চাদর, শাড়ীসহ সমস্ত প্রসাধনের জিনিসপত্রে ঠাসা বাংলাদেশি বিপণীবিতানগুলি। বইপত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেক বাংলাদেশি পণ্যের একটা অলটারনেটিভ ইন্ডিয়ান পণ্য আছে।

সবচাইতে বেশি যে পণ্য আমদানি হয় তা ইন্ডিয়ান সিনেমা। বম্বে, গুজরাতি, মারাঠি, কলিকাতার সিনেমায় ঠাসা দোকানগুলো তার ওপর সেটেলাইট টিভিতেতো আছে হরেক রকম ইন্ডিয়ান চেনেলের দাপট। ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গেলে খানিক ইতিহাসে মাথা গলাতেই হবে। অবিভক্ত ভারতের পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গ নিয়া বিশাল ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতির অবস্থান ছিল একদা। পশ্চিমবঙ্গ ইংরাজদের শতবছরের রাজধানী হওয়ায় শিল্পকারখানায় পূর্ববঙ্গের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল আর বিনিয়োগকর্তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। যেহেতু পূর্ববঙ্গ শিল্পকারখানায় পিছিয়ে ছিল। তারোপর বাঙালি হলেও অধিকাংশ মানুষই ছিল মুসলমান। গান্ধী প্রমূখ মারাঠাদের একনায়কতান্ত্রিকতার ফলে জিন্নাহ প্রমুখদের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাগখন্ডে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নিরিখে পূর্ববাংলাকে পূর্বপাকিস্তান বানানো অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এরা খানিকটা বাধ্যও ছিল কারণ খোদ পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়ারা কখনোই পুর্ববঙ্গের মুসলমান বাঙালিদের তাদের সমকক্ষ হিসাবে দেখতে চায় নাই। ইংরাজদের হাত ধরে ইংরাজি কালচারের অনুকরণের মাধ্যমে নিজেদের ইংরাজ রাজের সেবক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তারা। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গবাসী অধিকাংশ মুসলমান হয়েছিল নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ থেকে। মুসলমান হওয়ার কারণে ও ইংরাজরা মুসলমান শাসকদের হটিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করার কারণে ইংরাজদের পক্ষ থেকে যেমন মুসলমানদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তেমনি মুসলমানদের পক্ষ থেকে ছিল ঘৃণা, ভয় ও অনিহা। আর সবরকমের জাতীয়তাবাদের (ধর্ম,ভাষা,অঞ্চলভিত্তিক) উদ্গাতা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিলই।

যাইহোক, শুদ্ধ ধর্ম নিয়া যে রাষ্ট্রচালনা সম্ভব না তা অচিরেই প্রমাণিত হয়ে যায়। তা প্রথম উপলব্ধি করে শাসক পশ্চিম পাকিস্তানিরাই। রাষ্ট্র হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের আদতে কোনো রাষ্ট্রচরিত্র ছিলনা, এখনো নাই। সবসময় বিদেশি সাহায্য নির্ভর এই রাষ্ট্র। ফলে উৎসমুখ হিসাবে তাকে নির্ভর বা তৈরি করে নিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেই। পূর্বপাকিস্তানকে একটা কলোনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতো না তারা। পূর্বপাকিস্তানের উপর নির্ভর করেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু সাংস্কৃতিক নৈতিকতার কথা বললে জাতি হিসাবে পাকিস্তানি আর বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ এক ছিলনা। ফলে সাংস্কৃতিক ফারাক থেকে যে বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা দেখা দিল তার সুযোগ নিল ভারত। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উপনিবেশ থেকে পরিণত হল ভারতের মননের উপনিবেশে।

এই অসাধ্য সাধন হয়েছিল সাংস্কৃতিগতভাবে বাংলারমানুষ ভারতের সাথে জড়িত ছিল সুদীর্ঘ কাল থেকে। কারণ বাংলার অর্ধেক তো সবসময় ভারতের ভেতর। কিন্তু এই বাংলার অধিবাসীদের ভাষা বাংলা হলেও তারা যে অধিকাংশ মুসলমান সে কথাও ভারতের খেয়াল আছে। কিন্তু ভারতের সমস্যা অন্যজায়গায়। ভারতরাষ্ট্র বহুজাতিক রাষ্ট্র। বহু ভাষাভাষি যুক্তরাষ্ট্র। এক সাথে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটলে ভারত ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। হিন্দিকে সবভাষাভাষিদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে তাই ভারতকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেই অগ্নিপরীক্ষার পুলসেরাত হচ্ছে বলিউড বা ভারতের চলচ্চিত্র কারখানা। যেমন আমেরিকার হচ্ছে হলিউড পর্নইন্ডাস্ট্রি।

রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র হিসাবে ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মিল অনেক দিক দিয়ে। প্রথম মিল হচ্ছে দুইটি দেশই বহুভাষা, বহুসংস্কৃতির মিশেল। কিন্তু এই বহুসংস্কৃতিকে বহুভাষাকে একসুতায় গাঁততে না পারলে রাষ্ট্র হিসাবে টিকে না থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। আর তাই ভাষার সাম্রাজ্যবাদি চেহারা দেখা যায় বিশ্বের তিনটা ভাষায়। চায়নিজ মেন্দারিন, ইংরাজি আর হিন্দি। ইউনেস্কো স্ট্যাটাসটিক্যাল ইয়ারবুক (১৯৯৬) অনুযায়ী দেখা যায়। এই তিনটা ভাষা মাতৃভাষাভাষির চেয়ে ব্যবহারিক দিক দিকে এগিয়ে। চায়নিজ মেন্দারিন ৮০ কোটি লোকের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ১০০ কোটি মানুষ। ইংরাজি ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ১৯০ কোটি মানুষ। হিন্দি ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ৫৫ কোটি মানুষ। এই চিত্র অনেক আগের তা এখন বেড়ে নিশ্চয়ই দিগুণ হয়েছে। ভারতের অভ্যান্তরীণ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে দাবিয়ে রাখার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল বলিউড সিনেমা কারখানা। ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের মানুষ এখন একাধিক ভাষায় কথা বলে। নিজের প্রাদেশিক ভাষা (মাতৃভাষা), হিন্দি ভাষা ও ইংরাজি ভাষা (কোনোকোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে)। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্য থেকে একধাপ এগিয়ে। কারণ পশ্চিমবঙ্গ একসময় বৃটিশভারতের রাজধানী ছিল। ফলে ইংরাজিটা অনেক আগে থেকেই কলকাতায় থিতু। হিন্দিটা এখন ক্রমে থিতু হচ্ছে। হিন্দু থিতু হওয়ার পেছনে আগেই বলেছি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ততো ছিলই তার বাস্তবায়নে সবচাইতে ভূমিকা রেখেছে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। বলিউডের এই সম্ভাবনা দেখে অনেক আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এটাকে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প কারখানা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ইন্ডাস্ট্রি এখন গোটা উপমহাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে। 

রাশিয়ায় যখন প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হল, ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন দ্বিধান্বিত। লুমিয়র ভাইদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি বলেছিলেন ‘শেষ পর্যন্ত মানবজীবন ও মনের উন্নতিতে এই নব আবিষ্কার ব্যবহৃত হবে কিনা, লুমিয়রদের ট্রেনের ছবি, পারিবারিক ছবি শীঘ্রই বুর্জোয়াদের নগ্ন থাবায় স্থলাভিষিক্ত হবে, তখন ছবিগুলোর নাম হবে ‘যে নারী নগ্ন হচ্ছে, ‘স্নানঘরে মহিলা, ইত্যাদি। হয়েছেও তাই। সবদেশেই বুর্জোয়াদের চেহারা প্রায় আন্তর্জাতিক। তারা মত্ত সস্তা বিনোদনে। তাদের অন্যতম বিনোদন হচ্ছে যৌনতা। যৌনতা বিনোদন পরিণত হয়েছে এখনকার সবচাইতে লাভজনক ব্যবসায়। হলিউডি বুর্জোয়ারা যৌনফিল্ম উৎপাদন করে কোনো রাখঢাক ছাড়াই তারা যার নাম দিয়েছে পর্ণইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু বলিউডি বুর্জোয়ারা খায়েস থাকা সত্বেও সরাসরি পর্ণইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করতে না পারলেও তাদের প্রকাশভঙ্গি আরো মারাত্মক। যদিও বলিউডে বেশির ভাগ ছবিই পর্ণছবি। কিন্তু তারা এইটার সামাজিকীকরণ ঘটাচ্ছে। খানিকটা সমাজের ভয়ে তারা সরাসরি আগাইতে পারছেনা কারণ ভারতে বহুমানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। সামন্তীয়রা এখনো ঘাপটি মেরে আছে সমাজের রন্দ্রে তাদের ধর্মকর্মসহ। আর রাষ্ট্রের ব্যাপক অংশ শোষিত জনগণ যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের আফিমের (ধর্ম) ওপর ভর করে। আবার এই জনগণই বলিউডি এই আধাপর্ণ সিনেমা বাঁচিয়ে রাখার শক্তি। যদিও বলিউডি সিনেমায় সাধারণ জনগণের কোনো স্থান নাই। সিনেমায় তারা প্রায় চোর বাটপার, কালোবাজারী। বলিউডি কাহিনীগুলা পাতিবুর্জোয়াদের বুর্জোয়ায় পরিণত হবার খায়েস। বুর্জোয়াদের প্রেমবিলাস তথা শৃঙ্গার তথা কামবিলাসই হিন্দি সিনেমার মূলস্রোত। সেটা বলিউডের সিনেমাগুলা দেখলেই বুঝা যায়। আর এখনতো সিনেমার কাহিনীর ভেতরে অধিকাংশ নায়িকাই বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে আসে তারা স্বল্পবসনা, তথাকথিত আধুনিক, যৌনউন্মত্ত এবং বুর্জোয়া পরিবারের। শিক্ষাদীক্ষা শেষে তারা ভারতে আসে তাদের সাথে পরিচয় হয় পেটিবুর্জোয়া বা কোনো লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের যার জীবনবাসনা বুর্জোয়া হবার। এরপর বুর্জোয়ার প্রতিরোধের চেষ্টা। অগ্নি পরীক্ষা শেষে তাকে গ্রহণ করে বুর্জোয়া পরিবার। এর মধ্যদিয়ে অধিকাংশ সময় দেখানো হয় বুর্জোয়া মেয়েটার দেহবাসনা। এরমধ্যে আরেকটা শ্রেণিচরিত্র কাজ করে। বলিউডি যে কোনো শ্রেণির নারীই যৌনখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যাইহোক বাস্তবেও তাই বলিউডের প্রায় নায়িকারাই এখন বুর্জোয়া পরিবার থেকে আসা। সবাই প্রায় বিদেশের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা বিলাতের স্কুল কলেজে পড়া। প্রিয়াংকা চোপড়া, আমিশা পেটেল, ক্যাটরিনা কাইফসহ অনেকেই আছে। 

সাম্প্রতিক বলিউডি সিনেমায় ‘আইটেম সং’ বলে একটা জিনিস চালু হয়েছে। এটা যৌনতাকে সামাজীকিরণের আরেকটি ধাপ। নায়িকাদের যে যৌন আচরণ এখনো পর্যন্ত কাহিনীর ভেতর দিয়া দেখানো সম্ভব না তা এই আইটেম সংয়ের মধ্য দিয়ে দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি আইটেম সংগুলা গোটা সিনেমাকেই হিট করিয়ে দেবার যোগ্যতার প্রমাণও দিয়েছে। এইরকমই তিনটা আইটেম সং হচ্ছে, শিলা কি জওয়ানি, মুন্নি বদনাম হুয়ি, উলালা উলালা। গানগুলা যথাক্রম তিসমারখান, দাবাং ও ডার্টি পিকসার সিনেমার। গান তিনটার কথাগুলা খেয়াল করে শুনলে একটা জিনিস পাওয়া যায়। তিনটারই ভাবার্থ প্রায় অভিন্ন। গানগুলাতে যথাক্রমে ঠোঁট মিলিয়েছেন ক্যাথরিনা কাইফ, মালাইকা অরোরা, ও বিদ্যা বালান। তিনজনই শিক্ষিত সুন্দরী যৌবনবতী ও বুর্জোয়া পরিবার থেকে আসা। তিনটা গানেই যথেষ্ট দেহঝড় তুলেছেন তিনজনেই। তিনটা গানের কথাগুলাই খেয়াল করলে দেখা যাবে খদ্দেরদের সাথে যৌনকর্মীরা যে ধরনের কথা বলে বা দরদাম ঠিক করে প্রায় তার কাছাকাছি। টাকা নিয়া আসো এই ঢেকে রাখা যৌবন উপভোগ করো। 

যে ধরনের ইনস্ট্রোমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে । যে ধরনের উত্তেজক সুরে গানগুলা বাধা হয়েছে। তাতে একবছর ধরে গোটা উপমহাদেশে ও ভারতীয় চ্যানেলগুলাতে যেগুলা উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই প্রতিনিয়ত বেজে চলেছে। বাংলাদেশেও যে কোনো বিয়া বা মেহেদি অনুষ্ঠানে। দূর পাল্লার কোনো গাড়ীতে। যে কোনো অনুষ্ঠানেই বেজে চলেছে এই গানগুলা। স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা কানের মধ্যে মোবাইলের হেডফোন লাগিয়ে নিয়ত শুনছে এই গানগুলা। মোবাইলে ছোট স্ক্রীনে ফাকে ফাকে দেখেও নিচ্ছে। জীবনের, দৈনন্দিনের একটা বিশাল সময়জুড়ে তারা প্রায় নিজেদের অজান্তেই এই চর্চা করে যাচ্ছে অবিরাম।

এইগানগুলা ঠিক কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে’র চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে এই ভারতীয় সিনেমা, গান, সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য ইত্যাদি মিলিয়ে রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের আধিপত্যকে প্রশ্নহীন মেনে নেয়ার ব্যাপারে মননের ক্ষেত্র তৈরি করবে। একটা ভারতীয় সেভের লোশন শুধু লোশন না এইখানে মিশে থাকে সালমান, শাহরুখ, অক্ষয় কুমারের বিজ্ঞাপনি যাদু ও তাদের গ্রহণযোগ্যতা। একটা শ্যাম্পু বা ফেসওয়াস বা ক্রীম শুধু ক্রীম নয় তাতে মিশে থাকে কারিনা কাপুর, ক্যাথরিনা কাইফ, প্রিয়াংকা চোপড়ার গ্রহণযোগ্যতা। এগুলা প্রায় ভোক্তার নিজের অজান্তেই তার মনে গ্রহণযোগ্যতা বা আবেদন তৈরি করে রাখে সম্প্রসারণবাদী ভারতকে, তার আধিপত্যকে গ্রহণ করার ব্যাপারে। ঈদের মার্কেটে মেয়েদের পোশাকের নাম হয় শিলা, মুন্নি ইত্যাদি।

সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমাগুলা বাংলাদেশে আমদানি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে এখনো যেগুলা টিকে আছে। তাতে দেখানো হচ্ছে। যদিও এখনো কলকাতার বাংলা ছবি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে পুরানা হিন্দি ছবি ইত্যাদি দেখানোর মাধ্যমে একদম টাটকা মুক্তিপাওয়া সিনেমাও দেখানো হবে। সিনেপ্লেক্সগুলাতে। যদিও সিনেমা হল পর্যন্ত টাটকা সিনেমাগুলা দৌড়ে না আসার কারণ হচ্ছে এমনিতে ডিভিডি, সিডি, টিভি চেনেল দিয়া তারা সেই চাহিদা পুরণ করেছে। 

বাংলাদেশে বইয়ের দোকানগুলা পর্যন্ত ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। বইয়ের লাভজনক ব্যবসা মানে ইন্ডিয়ান বইয়ের ব্যবসা। নিয়মিত যারা শাহবাগের আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানে যায় তারা জানেন ইন্ডিয়ান বাংলা-ইংরাজি বইয়ের ভীড়ে বাংলাদেশি বইগুলাকে কেমন শীর্ণ দেখায়। সেল্ফের অপেক্ষাকৃত অনালোকিত স্থান হয় তাদের জন্য বরাদ্দ। এখানে বলা অসমীচিন হবে না। আমার প্রবন্ধের বই ‘রাজ্য ও সাম্রাজ্য'র পাঁচটা কপি আজিজ মার্কেটের ‘তক্ষশীলা’ নামের একটা দোকানে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে দিয়েছিলাম। আমার সামনেই একটা কপি সেল্ফের বেশ ভাল জায়গায় রাখল। দু’দিন পর পরিচিত একপাঠক যাকে আমি জানিয়েছিলাম বইটা এই দোকানে পাওয়া যায়। সে বইটা খুঁজে না পেয়ে আমাকে ফোন দেয়। কিছুদিন পর গিয়ে দেখি ইন্ডিয়ান বইয়ের জন্য দোকানে ঢুকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেল্ফে না দেখে জিজ্ঞেস করলে দোকানের মালিক বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, দেখছেন না বই আসছে, কলকাতার বই রাখার জায়গা নাই? একজন লেখক হিসাবে খুবই অপমানজনক অবস্থা। আমি বললাম, আমার বইগুলা আমারে দিয়ে দেন। দোকানি বলল, পরে আইসেন বই নীচে পড়ে গেছে। সন্দেহ করলাম আমার বইগুলা ভাগ্য হয়েছে কলকাতার বইগুলার রক্ষাকবচ হিসাবে, বইগুলার নীচে মেঝেতে। সত্যিকার অর্থেই একদিন অনেক বইয়ের নীচে একেবারে মেঝে থেকে তিনটা বই টেনে বার করলো। ততক্ষণে বইগুলা চেপ্টা হয়ে গেছে প্রায়। এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই থাকার কথা।

সেই একাত্তরের পর থেকে। বাংলাদেশের সাহিত্য, চিন্তা সবই প্রায় কলকাতা নির্ভর। এখনও কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, সমালোচকদের মত’ই আমাদের কাছে শ্রেষ্ট। তাদের সনদ না পেলে যেনো এদেশে কবি,সাহিত্যিক হওয়া যায় না। চিন্তা করা যায় না। সেই শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে অনেকেই এখনোব্দি কলকাতায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে ও কলকাতার কবি সাহিত্যিকদের বাংলাদেশে এনে নিয়মিত পায়ের ধূলা ও উপদেশ নিচ্ছে। বিদেশি সাহিত্য আমাদের পড়তে হবে। কলকাতার সব লেখক তৃতীয় শ্রেণির তা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। ভাল লেখকদের কখনো ডাকি না আমরা ডেকে আনি তৃতীয় শ্রেণির লেখকদের। মুন্নির জওয়ানি, শিলার বদনামির মতই তাদের লেখাজোকা নিজেদের অজান্তে আমাদের মননের ক্ষেত্র তৈরি করে তাদের মত করে, রাষ্ট্র হিসাবে প্রশ্নহীন ভারতীয় আধিপত্য মেনে নেয়ার ব্যাপারে।