মাহবুব রোকন ও রকিয়ত উল্লাহ।। মাতারবাড়ি মজিদিয়া সুন্নিয়া সিনিয়র আলীম মাদ্রাসা থেকে সরকারি বই উদাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি করার সিদ্ধান্তের প্রায় দুই মাস অতিক্রান্ত হলেও রহস্যজনক কারণে এখনও গঠন হয়নি সেই তদন্ত কমিটি। অভিযোগ ছিলো বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই পুড়িয়ে ফেলা, অবৈধ ভাবে সরকারি বই বিক্রি করে দেওয়া, নারীঘটিত ঘটনার অভিযোগ, অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে মাতারবাড়ি মজিদিয়া সুন্নিয়া সিনিয়র আলীম মাদ্রাসার শিক্ষক পরিচালনা কমিটির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এনিয়ে গত বছরের ২৩ নভেম্বর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ফয়জুল করিমের উপস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে মাদ্রাসায় বৈঠকও হয়েছিলো। বৈঠকে বিভিন্ন শিক্ষকদের নানা অনিয়মের অভিযোগগুলো খসড়া আকারে পরিচালনা কমিটির সভাপতি, শিক্ষক ও অভিভাবকের স্বাক্ষরে লিখিত রেজুলেশন করা হয়। সেবার এ সব বিষয় বিবেচনায় উত্তাপিত বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস। প্রতিষ্ঠানটিতে চলমান টানা সংকটের কারণে তাতে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
বৈঠকে উপস্থিত সদস্যদের স্বাক্ষরিত লিখিত বক্তব্য সূত্রে জানা যায়, মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থাকা রফিকুল হায়দারের বিরুদ্ধে অফিস সহকারী মুবিনের সহয়তায় সরকারি বই বিক্রির অভিযোগ আনা হয় বৈঠকে। এছাড়াও রফিকুল হায়দার বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই পুড়িয়ে ফেলেছে ও নারীঘটিত বিষয়ের সাথে যুক্ত বলে অভিযোগ আনা হয়।
তাছাড়া শিক্ষার্থীদের ভর্তির টাকা আত্মাসাৎ সংক্রান্ত আলোচনায় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নুর বক্স ৪৮ হাজার ৯ শত ৫০ টাকা, আক্তার কামাল ৩২ হাজার ৮ শত ৫০ টাকা, ইকবাল বাহার ৩১ হাজার ৮ শত টাকা ও নুরুল হাকিম ৯ হাজার ৯ শত টাকা এবং মাদ্রাসার সভাপতি তৎকালীন মাতারবাড়ির ইউপি চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ ৮৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে মর্মে বৈঠকে অভিযোগ আনা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে -মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের উপস্থিতিতে গত বছরের ২৩ নভেম্বরের এ বৈঠকে একটি কার্যকর তদন্ত কমিটি গঠনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসলেও এ পর্যন্ত রহস্যজনক কারণে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়নি।
অন্যদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে অধ্যক্ষ মাওলানা কামাল হোসেন নিয়মমতো অবসরে গেলে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয় রফিকুল হায়দারকে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেউ নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় মীর মোশাররফ হোসেনকে। এ নিয়ে মাদ্রাসার সভাপতি মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রফিকুল হায়দারের মধ্যে বেশ ঠাণ্ডা লড়াই চলতে থাকে। দু'জনই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পরস্পর বিরোধী একের পর এক লিখিত অভিযোগ দিতে থাকেন। এরইমধ্যে নাটকীয় ভাবে ফের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়া হয় রফিকুল হায়দারকে। এ সব বহুমুখি ঘটনার ভেতর দিয়েই এক ধরণের উত্তেজনা নিয়ে চলতে থাকে মাদ্রাসাটির কার্যক্রম। এ সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরণের হতাশা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠা মাদ্রাসা শিক্ষক নুর বক্স এর কাছে জানতে চাইলে তিনি উল্টো অভিযোগ করে বলেন -অফিস সহকারী মুবিনের সহয়তায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রফিকুল হায়দার সরকারি বই বিক্রি করে দিয়েছেন। তা আমরা সংশ্লিদের অবগত করলেও কোন ব্যবস্থা নেননি এখনো।
অভিযোগ ও সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রফিকুল হায়দার বলেন -প্রতিষ্ঠানের টাকা সভাপতি মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ ও কয়েকজন শিক্ষক মিলে আত্মসাৎ করছে। সে বিষয়ে আমি সক্রিয় হওয়ায় এখন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে তারা। তদন্ত কমিটি গঠন না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি -'এখন আমরা আপোষ হয়ে গেছি' বলে মন্তব্য করে এর বেশি কিছু জানাতে রাজি হননি।
প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মাতারবাড়ির সাবেক চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, সরকারি বই বিক্রি, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বই পুড়িয়ে ফেলা ও নারীঘটিত ঘটনার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ ওঠার পর বিষয়টি তাৎক্ষণিক ভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবগত করি এবং শিক্ষক ও অভিভাবকসহ মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার উপস্থিততে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির বৈঠকে লিখিতভাবে দ্রুত তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিলেও এখনও বিষয়টির আর কোন অগ্রগতি হয়নি।
মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফয়জুল করিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিভিন্ন ব্যস্ততায় তদন্ত কমিটি করা সম্ভব হয়নি বলে জানান এবং দ্রুত তদন্ত কমিটি করার জন্য ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ রফিকুল হায়দারকে আবারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য দেন।
মাদ্রাসাটিতে চলমান বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সাইফুল ইসলাম জানান, যেহেতু সরকারি বই বিক্রি, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই পোড়ানো ও নারীঘটিত ঘটনার মত স্পর্শকাতর বিষয়ে অভিযোগ এসেছে, তাই বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে মাতারবাড়ির ঐতিহ্যবাহী এ মাদ্রাসায় নিজেদের স্বার্থের বিষয় বিবেচনায় বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অব্যহত রশি টানাটানি ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি চলার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ঐতিহ্য হারাতে বসেছে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এমন পটভূমিতে শিক্ষার পরিবেশ মারাত্মক ভাবে ক্ষতি হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয় অনেকই। এলাকার শিক্ষা সচেতন লোকজন এ পরিস্থিতির জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার(একাডেমিক সুপারভাইজার)'র রহস্যজনক নির্লিপ্ত ভাব ও দায়সারা অবস্থনকেই দায়ি করছেন।