Advertisement


দুর্যোগ প্রবণ মহেশখালীঃ দুর্বার হোক আমাদের প্রস্তুতি


শাহারিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন

দুর্যোগ এবং বাংলাদেশ [ Disaster and Bangladesh ] একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত, ভৌগোলিক অবস্থান আমাদেরকে বাধ্য করেছে দুর্যোগ এর সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকতে। আধুনিক যুগে এসে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় চারদিক আলোকিত হলেও কেন জানি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে তার ছোঁয়া মিলছেনা।  তবে মজার বিষয় হচ্ছে– প্রযুক্তির সুষ্ঠু ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দুর্যোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। ফলশ্রুতিতে, উভয়টি এখন অনেকটা সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে, বর্তমান বৈশ্বিক জলবায়ু [ Global climate ] পরিবর্তন পুরা বিশ্বকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে, অভাবনীয় একটি সংকট এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো প্রতিনিয়ত আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে প্রকৃতি বিরুদ্ধ কাজে মেতেছে। এছাড়াও, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকছে। অর্থাৎ, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারে বিশ্বজুড়ে এখন চলছে চরম প্রতিযোগিতা। উৎপাদিত ও ব্যবহৃত হচ্ছে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন যন্ত্রপাতি। দেখুন, আমি প্রযুক্তির বিপক্ষে না। তবে, আমি তার উৎকৃষ্ট ব্যবহারকেই আলোকপাত করছি। যদি পৃথিবী-ই অরক্ষিত হয়ে পড়ে, বিলীন হওয়ার মুখে পড়ে, তাহলে প্রযুক্তি দিয়ে আমরা করবোটা কী? একটু গভীর চিন্তা করলেই দেখা যায়, এত এত দূর্যোগের পেছনে  প্রযুক্তির অপব্যবহার কোন না কোনভাবে বৃহদাংশে দায়ী। জীবনের তাগিদে আমাদেরকে উন্নত হতে হচ্ছে, শিল্পায়নের দিকে ধাবিত হতে হচ্ছে। কিন্তু, তাই বলে প্রকৃতিকে পিষে নাকানিচুবানি খাইয়ে কিংবা তার স্বাভাবিক শ্রোতকে বাঁধা দিয়ে উন্নতি করবো, এটা চরম বোকামি। তাই, প্রযুক্তির সাথে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য এনার্জির সম্মিলন করে বিকল্প পন্থা আবিষ্কারের দিকে অন্তত এই মুহূর্ত থেকে দৃষ্টি বাড়াতে হবে বলে আমি মনে করি৷


সম্প্রতি জাতিসংঘের [ United Nations ] জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেলের (আইপিসিসি) ওয়ার্কিং গ্রুপ-২ এর একটি প্রতিবেদন দেখে বড্ড অবাক হয়েছি। সেখানে বলা হয়ছে– “জলবায়ু পরিবর্তনের [ Climate change ] কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আগের চেয়ে বেশি হবে। জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশের বার্ষিক দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ২ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশ কমতে পারে এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১ থেকে ২ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত[ Displaced ] হতে পারে।” যদিও এরকম কথা আগে থেকে বলা হচ্ছে। কিন্তু, জলবায়ু মোকাবেলায় বেশ সুন্দর পলিসি দেখলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে। ফলশ্রুতিতে, এই বৃহৎ সংকট মোকাবেলায় আমরা দূরে সরে পড়ছি। এমনিতেই ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান 'লোয়ার স্ট্রিমে' হওয়ায় আশেপাশের দেশগুলোতে কোন দুর্যোগ দেখা দিলে তার ভোগান্তি আমাদেরকেও পোহাতে হয়। তার উপর আমরা যদি উদাসীন হয়, তাহলে অচিরেই বাংলাদেশকে তার বিরূপ ফল ভোগ করতে হবে। শুধু বাংলাদেশ নয় বরং উন্নত দেশ যেমন, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, তুরস্ক, কানাডা [ Canada ], আমেরিকা ইত্যাদি দেশগুলোতেও জলবায়ু পরিবর্তন এখন চোখ উঠার মতো৷ হঠাৎ তাপমাত্রা এক্কেবারেই কমে যাওয়া বা অধিকতর বৃদ্ধি পাওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যা, ভূমিকম্প, মরুকরণ, ঘুর্ণিঝড় [ Cyclone ] , টর্নেডো, পাথর বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রতিনিয়ত আঘাত হানছে কিংবা দাবানলে জ্বলছে বনাঞ্চল, পাহাড়-পর্বত। ইদানীং আমাদের দেশেও তার প্রভাব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যা নিশ্চয় আমাদের জন্য সুখকর নয়।

ছোট্ট এবং অতি পরিচিত একটা উদাহরণ দিই– বাংলাদেশের আবাহওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এছাড়াও, আমাদের দেশকে ষড়ঋতুর দেশ বলা হয়ে থাকে। কিন্তু, বর্তমানে কি ষড়ঋতু পরিলক্ষিত হয়? অবশ্যই না! বরং একটু গভীর দৃষ্টিপাত করলেই স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় মাত্র এক-দুইটা ঋতু। বাকি ঋতুগুলো অনেকটা উধাও। এটা কিন্তু এমনিতেই হয়নি। Climate change এখন Climate chaos. অর্থাৎ, তা আর নিয়ন্ত্রণে নাই বরং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আছি আমরা। বর্তমান ঢাকা শহরের অবস্থার কথা চিন্তা করে মাঝেমাঝে স্তম্ভিত হয়। এই শহর এখন মাত্রাতিরিক্ত বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, কার্বনডাইঅক্সাইড, কল-কারখানার [ Mills ], রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, অপরিকল্পিত নগরায়ন ইত্যাদিতে ভরপুর। অতিরিক্ত বর্জ্য ও দূষণের ফলে বুড়িগঙ্গা নদীটাও এখন মৃত প্রায়। এক কথায় বাসযোগ্যতা হারিয়েছে বহু আগেই! পরিস্থিতি এখন অনেকটা প্রাকৃতিক দূর্যোগের অপেক্ষায়। কখন কোনদিক থেকে কীভাবে ব্লাস্ট হয়, তা বলা মুশকিল।

ঠিক এই বিরাট সংকট এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বারবার বলতে হয়– জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে। কার্বনডাইঅক্সাইড, প্লাস্টিক পণ্য, পলিথিন, বৃক্ষ নিধন, ইত্যাদি কমিয়ে আনতে। বাংলাদেশ যেহেতু দুর্যোগ প্রবণ একটি দেশ তাই সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব, গ্লোবাল ওয়ার্মিং [ Global warming ] এর তীক্ষ্ণতা, ওজোনস্তর হ্রাস, প্রতিনিয়ত কলকারখানার বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, বন্যা, বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি ঘটতে থাকলে বাংলাদেশের অস্তিত্বও থাকবেনা। সম্প্রতি দেখেছি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় জন্মহার হ্রাস পাচ্ছে, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে মাতৃ স্বাস্থ্যে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে, নতুন নতুন রোগের আবির্ভাব হচ্ছে, কৃষিতে ধ্বস নামছে আরো কত কি।

অতএব, প্রকৃতি ও মানবসৃষ্ট প্রতিটা দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, দুর্যোগ মোকাবেলায় কলাকৌশল বা প্রশিক্ষণ প্রদান, ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা, আর্থসামাজিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার, আশংকাজনক জায়গাগুলোতে গভীর দৃষ্টিপাত ও পূর্ব পরিকল্পনা গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে যথেষ্ট সচেষ্ট থাকতে হবে। এছাড়াও, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫°C এ সীমাবদ্ধ রাখা, বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি বাড়ানো, প্রকৃতি বিরুদ্ধ এমন প্রকল্প রোধ করণ, দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি, শিক্ষা কারিকুলামে জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত পাঠ সংযোজন ও তা প্র্যাকটিকালি প্রদর্শন ইত্যাদি বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশ আশা করতে পারি। তবে, আশার বিষয় হচ্ছে মানুষ এখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে ভাবছি, তরুণরা এগিয়ে আসছে, পলিসি তৈরিতে বৈচিত্র্যময় মানুষের অংশগ্রহণ ও ইনোভেটিব ভাবনা উঠে আসছে। এখন শুধু তার যথাযথ ব্যবহার ও প্রায়োগিক দিক বাকি। দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবসের শপথ হোক দুর্যোগ মোকাবেলায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

লেখক: শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন
মহেশখালীর সন্তান, শিক্ষার্থী- ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।