Advertisement


আজ ৩ মার্চ: একাত্তরের এইদিনে

মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন

মাদের জাতীয় জীবনে কয়েকটি দিন অবিস্মরণীয়, আলোকিত, গৌরবোজ্জ্বল। পাকিস্তানি জান্তারা জাতীয় পরিষদের সভা মুলতবি করে মূলত নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়াল মেরেছিল। শান্ত এ জাতিকে জাগ্রত করার কাজকে ত্বরান্বিত করেছিল তারা। দুই মার্চ তারিখে মিছিল, সভা-সমাবেশে উত্তাল ছিল ঢাকার রাজপথ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে হরতাল চলছিল। সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে ধীরে ধীরে আমরা স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যটার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। উত্তাল জনতা কেবলি আঙ্গুলি হেলনির অপেক্ষায়। দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিধ বঙ্গবন্ধু সময়ের অপেক্ষা করতে লাগলেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতে লাগলেন।

মার্চের তিন তারিখেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ছিল। পাকিস্তানিদের হঠকারি সিদ্ধান্তের কারণে এদিন অধিবেশন আর বসেনি। ইয়াহিয়া খান বোঝতেই পারলেন না এ দেশের কৃষক, শ্রমিকের সাথে কি বিশ্বাসঘাতকতাই তারা করলেন, কী হতে পারে এর প্রতিক্রিয়া!

পহেলা মার্চ ইয়াহিয়া খানের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় অধিবেশন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলা। এ দিন আন্দোলনের আলোকচ্ছটা গ্রাম বাংলার অলি গলি পর্যন্ত গিয়ে শিহরণ তোলে মানুষের হৃদয়ে। মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে, মুক্তির আশায়। একটি স্বাধীন দেশের আশায়, স্বপ্ন দেখে একটি জাতীয় পতাকার।


স্বাধীনতার লাল সূর্যের দিকে চলমান আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য গতি পেয়েছিল এদিন। এদিন পল্টনের এক জনসভায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে পাঠ করে স্বাধীনতার ইশতেহার। রূপিত হয়ে যায় স্বাধীনতার বীজ। স্বাধীনতা সংগ্রাম কিভাবে চলবে, কৌশল কি হবে, কে নেতৃত্ব দিবেন, কিভাবে নেতৃত্ব দিবেন, সমগ্র দেশকে কিভাবে সমরক্ষেত্র করা যায় তার বিবরণসহ ঘোষনা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। আমাদের আত্মপরিচয়ের শিরোনামটিও পাওয়া যায় এদিন। পূর্ব সিদ্ধান্তের আলোকে ঘোষণা করা হয়, এ দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। সিদ্ধান্ত হয় সবুজে ঘেরা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশের জাতীয় পতাকা হবে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা আর ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান হওয়ার সিদ্ধান্ত এ সমাবেশেই হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের সব রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণও হয় এদিনে।
তিনি মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারতেন। তিনি জানতেন কখন কি বলা উচিত। মানুষ কি চায়। তাদের মনের আকুতি কী? তিনি তাঁর ভাষনে প্রকাশ্যে "স্বাধীনতা" শব্দ উচ্চারণ করেন । জনসভায় বঙ্গবন্ধু ''স্বাধীনতা'' শব্দটি উচ্চারণ করতেই সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে লক্ষ জনতা। এ যেন হানাদার শাসকগোষ্টির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষনা।

এদিন পল্টনে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় জাতির জনক কর-খাজনা দেওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন। জনসভায় তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালানোর রূপরেখা দেন ওই ভাষণে। একই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করেন। তিনি বলেন, ‘হয়তো ইহাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সে সুযোগ আমাকে নাও দেওয়া হইতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলিয়া যাইতেছি, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে।’

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘বাংলার ভাইয়েরা আমার- আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি- বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তাঁরাই নেতৃত্ব দিবেন। আর যদি কেউই না থাকে, তবু আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে- যে কোনও মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনাইয়া আনিতে হইবে।’

প্রথমবারের মতো সেদিন বিপুল সংখ্যক নারী লাঠি হাতে যোগ দেন মিছিলে। সমস্ত অফিস আদালত বন্ধ করে মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠে নগরী। এদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বহু লোক পাক সেনাবাহিনীর গুলিতে শহিদ হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিলে পাক সেনাদের গুলিবর্ষিত হয় নির্মমভাবে। তথ্যমতে, এদিন ঢাকায় কমপক্ষে ২৩ জন এবং চট্টগ্রামে কমপক্ষে ৭৫ জন মিছিলকারী পাক সেনাদের গুলিতে শহিদ হন। ঢাকা, সিলেট ও রংপুরে কারফিউ জারি। ঘটনার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। মুক্তিকামী জনতাকে প্রতিরোধ করতে অপকৌশলের অংশ হিশাবে এদিন সামরিক সরকার সারাদেশে জারি করে কার্ফু। হঠকারিতা ও অপকৌশলের অংশ হিশাবে পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১০ মার্চ জাতীয় পরিষদের নেতাদের বৈঠক আহ্বান করে এক বার্তা দেয় এদিন। দূরদর্শী ও প্রাজ্ঞ রাজনীতিক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেন এ আহ্বান। লক্ষ্যপানে চলতে থাকে আমাদের পথচলা।