Advertisement


১ মার্চ: একাত্তরের এই দিনে

মুহাম্মদ হেলাল উদ্দিন

মার্চ কেবল একটি মাসের নাম নয়। অন্তত বাঙ্গালির জীবন ইতিহাসে নয়। মার্চ একটি গল্পের নাম, একটি ইতিহাসের নাম, আবেগের জায়গা, উদ্দীপনা আর প্রেরণার সূচনা। মার্চ মানেই রক্তের চাদরে মোড়ানো একটি সবুজ দেশের মানচিত্র। প্রিয় বাংলাদেশের মানচিত্র। মার্চ মানে আমাদের স্বাধীনতার অগ্নিঝরা ঘোষনা। জাতির জনকের কাল


জয়ি মহাকাব্যিক ভাষনই আমার কাছে পুরো বাঙ্গালির ইতিহাস।


আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, দেখিনি সেই রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। আমি মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ট হয়েছি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে। সেদিক থেকে নিজেকে সৈভাগ্যবানই দাবি করি। তবুও মাঝে মাঝে দিকভ্রান্ত হয়ে বিষাদে ডুবে যাই, যখন এ দেশের নোংরা রাজনীতির প্রভাব বিস্তারে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ না দেখলেও হৃদয় থেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করেছি অনুভবটুকু। কখনো কখনো তা বয়োজ্যষ্ঠদের চাক্ষুস বর্ণনায়, আবার কখনো কখনো বইয়ের পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ছাপার অক্ষরে। আমার মতো এই তরুণ প্রজন্মের কেউই মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। তারাও শেকড়ের সন্ধানেই খুঁজে নিয়েছে আমার মতোই পন্থা। কিন্তু এই স্পর্শকাতর রক্তাক্ত ইতিহাসকে যখন বিকৃত করে উপস্থাপণ করা হয় ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারে তখন নূতন এই প্রজন্ম ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাস গিলতে গিলতে দ্বিধার মাঝেই ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। পুরো মার্চেই আমাদের সংগ্রাম রচিত হয়েছে নতুন করে, নতুন রূপে। ১ লা মার্চ থেকেই শুরু হয়েছে এ ইতিহাসের দৃশ্যমান পথচলা।

মার্চের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণই ছিল একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায়। ক্রমশই উত্তাল ছড়াচ্ছিল পলি মাটির বঙ্গদেশে। মূল মন্ত্র বা মহাকাব্যটি আনুষ্ঠানিক প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মার্চ, "আর দাবায় রাখতে পারবে না"-এর মাধ্যমে।

মার্চ-১, ১৯৭১
গ্রেগরীয় পঞ্জিকায় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ,  দুপুর প্রায় ১ টা বেজে ৫ মিনিট। ঢাকার হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় ইতোপূর্বে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজ চলছিল, ঠিক এসময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদানের অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে পূর্বনির্ধারিত ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনটি স্থগিত ঘোষণা করে। যেটির আবেদন পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো করেছিলেন ২৮শে ফেব্রুয়ারী। ভুট্টো সেদিন বলেছিল, যদি তাঁর পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে ৩ মার্চ অধিবেশন বসে, তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত জীবনযাত্রা নীরব-নিথর করে দেওয়া হবে। এর ঠিক ঠিক পরপরই ষড়যন্ত্রের নীলনকশা অনুযায়ী ইয়াহিয়া খান অধিবেশনের স্থগিতাদেশ দেয়। কিন্তু এ সময় এটি কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিংবা সাধারণ মানুষ কারোর পক্ষেই মেনে নেয়া সম্ভব ছিলো না। স্থগিতাদেশ শুনার সাথে সাথে বিক্ষুব্ধ জনতা সেদিন দুপুরেই তীব্র প্রতিবাদে নেমে আসেন রাজপথে। আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে ওঠে সকলে। জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে হোটেলের চারপাশ। স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠে পল্টন। এ সময় হোটেল পূর্বাণীতে অবস্থান করছিলেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতিক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হয় হোটেল পূর্বাণীতে। মানুষ নির্দেশনা চায়। উত্তাল জনতাকে শান্ত করা খুব সহজ ছিল না। তবুও দায়িত্ব তুলে নিলেন নিজেই। বঙ্গবন্ধু সমবেত হাজারো জনতার সম্মুখে এসে বক্তব্য দেন। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করাকে গভীর ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে জনগণকে আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু সেদিনই, দুই তারিখ থেকে পাঁচ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিন বেলা দুইটা পর্যন্ত হরতাল ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী কর্মসূচি ৭ই মার্চ ঘোষণা করা হবে বলে জানান। এদিকে পাকিস্তান সরকার গভর্নর আহসানকে পদচ্যুত করে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেন এদিন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, "শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য সারা বাংলাদেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন। জনাব ভুট্টো ও জনাব কাউয়ুম খানের দল ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি সকল সদস্যই অধিবেশনে যোগ দিতে রাজি ছিলেন।"

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ভাষণের পরেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকার রাজপথ।
সামরিক আইন পরিচালক লে. জে. সাহেবজাদা এম ইয়াকুব খান ১ মার্চ গভীর রাতে ১১০ নং সামরিক আইন আদেশ জারি করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশের ব্যাপারে সংবাদপত্রসমূহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। নির্মমভাবে ঘোষণা করা হয়, আইন ভঙ্গ করলে ২৫ নং সামরিক আইনবিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে। শুরু হলো অগ্নিঝরা মার্চের পথচলা।