Advertisement


উন্নয়ন প্রকল্পে জৌলুস হারাচ্ছে মহেশখালীর কুহেলিয়া নদী

#নদী ভরাট হলে বাড়বে সুপেয় পানির সংকট
#কুহেলিয়া রক্ষার দাবি পরিবেশকর্মীদের


কাইমুল ইসলাম ছোটন।। কক্সবাজারের উত্তর-পশ্চিমে চকরিয়া উপজেলা পেরিয়ে পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালী। জেলা শহর থেকে ৩৩.৫ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত মহেশখালীর কুহেলিয়া নদী। উজানটিয়া থেকে শুরু হয়ে নদীটি ধলঘাটা, মাতারবাড়ী ও কালারমারছড়া ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এসময় জোয়ার-ভাটায় আপন গতিতে ভরা যৌবনে প্রবাহিত হতো কুহেলিয়ার স্রোত। নদীতে বড় বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল করত। মাঝ নদীতে জেলেরা উত্তাল তরঙ্গের মধ্যে মাছ আহরণ করত। নদীর প্যারাবনের সৌন্দর্য মানুষের দৃষ্টি কেড়ে নিত। এক সময় যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে এ নদী দিয়ে বড় বড় নৌকা চলত। উৎপাদিত লবণ এখন থেকে নৌকা করে ঢাকা, খুলনা, সিলেট ও নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যেতো। চট্টগ্রাম থেকে মালামাল আনা নেওয়াসহ মানুষ বড় নৌকা করে চট্টগ্রাম শহরে যাতায়াত করত। নির্দিষ্ট সময় পর পর নৌকা যেত এখান থেকে। নদীমাতৃক দেশে প্রাণচঞ্চল কুহেলিয়ার নদীর সেই চেনা দৃশ্য এখন রূপকথা।

এক সময়ের খরস্রোতা কুহেলিয়া জৌলুস হারাচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পে। দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে নদীটি। নদী দখল করে চার লাইনের সড়ক নির্মাণ করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে চলছে চিংড়ী ঘেরের নামে প্রভাবশালীদের নদী দখলের মহোৎসব। বছর দশেক পূর্বে কয়েক হাজার মণের লবণের বোট চলাচল করলেও এখন সাধারণ নৌযান চলাচলই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত ১৪ মার্চ কুহেলিয়া নদী রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন ও করেছেন ৩ টি পরিবেশবাদী সংগঠন।

স্থানীয়রা বলেন, এক সময় নদীটি অনেক গভীর ছিলো। অনেক বড় বড় নৌকা ভিড়ত। এখন নদী দখল করে সড়ক নির্মাণ ও দূষণের ফলে নদীটি ছোট হয়ে গেছে। আগের মতো জোয়ার-ভাটা নেই, জাল ফেললেও সামুদ্রিক মাছের দেখা মিলে না। জেলেরা বাধ্য হচ্ছেন পেশা বদলাতে। আয় না থাকায় নিরবে কাঁদছেন বহু পরিবার।

অনেক প্রভাবশালী গোষ্ঠী চিংড়ি ঘেরের নামে বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে আতাঁত করে প্যারাবন কেটে নদী দখল করছেন। নদী ভরাট হয়ে গেলে ধলঘাটা-মাতারবাড়ী মানুষের জনজীবন হুমকির মুখে পড়বে। ইতোমধ্যে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় পানি বন্দী হয়ে পড়েন কয়েক হাজার মানুষ।

স্থানীয়রা আরও বলেন, কুহেলিয়া নদীর গভীরতা না থাকায় পানির লবণাক্ততাও কমে গেছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লবণচাষীরা। নদী ভরাট হয়ে গেলে মহেশখালীতে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে যাবে বেকারত্বের সংখ্যা।

স্থানীয়রা পরিবেশ কর্মীরা জানান, কুহেলিয়া নদীকে কেন্দ্র করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে মহেশখালীতে বসবাসরত দরিদ্র ২ হাজারের অধিক জেলে পরিবার। রাস্তা নির্মাণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে উক্ত জেলে পরিবারসমূহ পড়েছেন বিপদে। মহেশখালী ও মাতারবাড়ী এলাকা দেশের লবণ শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই নদী দিয়ে বছরে চার-পাঁচ মাস গড়ে দৈনিক ২০-২৫টি লবণের নৌকা যাতায়াত করত। অত্র এলাকায় ভারী শিল্পায়ন ও নদী ভরাটের কারণে লবণচাষি, সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে পড়েছে।

পরিবেশ কর্মীরা আরও জানান, নদী ভরাট হলে সুপেয় পানির সংকট বাড়বে। বারবার প্রতিবাদ করলেও দখল-দূষণ থামছে না কুহেলিয়ার।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ব্রীজ থেকে দক্ষিণে মাতারবাড়ী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পে যাওয়ার জন্য নদীর অর্ধেক অংশ দখল করে চার লাইনের সড়ক নির্মাণের কাজ করেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। সড়কটি যত দক্ষিণে তত নদী দখলের পরিমাণ বেড়েছে। তাছাড়া কালারমারছড়ার ইউনুসখালী এলাকায় নদীর প্রায় দুই কিলোমিটার অংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির ভরাটের ফলে নৌ যোগাযোগে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে এভাবে জৌলুশ হারিচ্ছে কুহেলিয়া নদী। অন্যদিকে মাতারবাড়ীর খন্দারা বিলে চিংড়ী ঘেরের নামে নদী দখল করছেন কয়েকটি চক্র।

স্থানীয় জেলে আবুল কালাম বলেন, নদীতে আগে অনেক মাছ পাওয়া গেলেও, বর্তমানে মাছ পাওয়া যাই না। তাই মাসের প্রায় সময় কাজ না পেয়ে বেকার থাকি। সংসারে নেমে পড়ছে অশান্তি। এমন অনেক জীবনগাথা কুহেলিয়া ঘিরে।

নয়ন দাশ নামে একজন বলেন, এসময় নদীতে আমরা অনেক কাঁকড়া পেতাম। যেগুলো বিক্রি করে সংসার চলত। বর্তমানে কাঁকড়া মিলে না, তাই নিজের জন্মভূমি ছেড়ে চট্টগ্রামের একটি কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। তার মতো আরও অনেকে কাঁকড়া ধরে জীবনধারণ করত বলে তিনি জানান।

কুহেলিয়া নদী রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব আবু বক্কর ছিদ্দিক বলেন, কুহেলিয়া নদীর সাথে মহেশখালী মানুষের জীবন জীবিকা জড়িত রয়েছে। কুহেলিয়া নদী ধ্বংস করা হলে মহেশখালী মানুষের উপর চরম অন্যায় অবিচার করা হবে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের ওজুহাত দেখিয়ে নদী দখল করে সড়ক নির্মাণসহ মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বর্জ্য ফেলা এবং চিংড়ি ঘেরের নামে নদী দখলের ফলে নদীটি হারিয়ে যাবে। জীবিত এই নদীর উপর নির্ভর ছিল তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা। কুহেলিয়া নদী দখলমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নদীটি উদ্ধারের দাবি জানান।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপা'র কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, দখল ও দূষণের ফলে কুহেলিয়া নদীটি এখন মৃত খাল। কুহেলিয়া নদী রক্ষা করা গেলে এটি চলমান বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে। তাতে রাষ্ট্র উপকৃত হবেন। তাই নদীটি রক্ষা করতে এখনই পদক্ষেপ না নিলে কুহেলিয়া নদী বাঁচানো যাবে না। আমরা কুহেলিয়া নদী রক্ষায় অনেক আন্দোলন করেছি। প্রতিবাদ করেছি। তিনি কুহেলিয়া নদী রক্ষার দাবি জানান।