Advertisement


পা হরিয়ে নিঃস্ব বড় মহেশখালীর আলাল এর মানবেতর জীবন


নিজস্ব প্রতিবেদক।।
গত ২ জুন রাত তখন প্রায় সাড়ে তিনটা। অধিকাংশ যাত্রী গাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন। নুরুল আলালও কিছুটা ঘুমের মধ্যেই ছিলেন। তাদের সৌদিয়া পরিবহনের গাড়িটি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে ছুটছিল। হঠাৎ তার ঘুম ভাঙ্গে। দেখে বেপরোয়া গতিতে বাস চলছে। তখনি হঠাৎ চট্টগ্রামগামী একটি ট্রাকের পিছনে ধাক্কা দিলে তাদের সৌদিয়া পরিবহনের বাসের সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে যায়। এ সময় আলালের পা ক্ষত বিক্ষত হয়ে পায়ের তিনটি সুক্ষ রক্তনালী ব্যাতিত সম্পূর্ণ পা কাটা পড়ে।

নুরুল আলাল কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার বড় মহেশখালী ইউনিয়নের মিয়াজির পাড়ার মো.  শফির বড় সন্তান। বাবা-মা, ৪ ভাই ও ৩ বোনের পরিবারে হাল ধরে ছিলেন বড় ছেলে আলাল। বর্তমানে তার ঘরে স্ত্রী এবং দুই বছরের মেয়ে তাসনিয়া আলাল ও দশ মাসের পুত্র তাসনিম আলাল রয়েছে।

আলাল চট্টগ্রাম বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে স্নাতক এবং সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পারিবারের আর্থিক অনটনের কারণে আইন পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য দীর্ঘ কয়েক বছর অপেক্ষা করতে পারেননি। জীবন-জীবিকার তাগিদে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরিতে যোগদান করেন । ফিরে এনেছেন পরিবারে স্বচ্ছলতা। আলাল যখন তিল তিল করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু করেছেন এবং দুই অবুঝ শিশুর ভবিষ্যত গড়ার লক্ষ্যে স্বপ্নে বিভোর, ঠিক তখনই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সৌদিয়া বাস ও ট্রাকের সঙ্গে সংঘর্ষের পর সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায় তার। ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় সৌদিয়া বাসে থাকা এক যাত্রীর প্রাণ যায়। আলাল প্রাণে বাঁচলেও এখন দুঃসহ যন্ত্রণার জীবন কাটাচ্ছেন। চিকিৎসাধীন স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালেই দিন কাটছে আলালের স্ত্রীর। এদের সাথে আছেন দুই অবুঝ শিশু।

সেদিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আলাল বলেন- নতুন চাকুরির সুবাদে ঢাকায় বউ বাচ্চাকে নিয়ে আসার জন্য বাসা ভাড়া করেন তিনি। নিয়ম অনুযায়ী পহেলা জুন থেকে উঠতে হবে পরিবার নিয়ে বাসায়। তাই পহেলা জুন বৃহস্পতিবার অফিস শেষে রাত ১১টা ১৫ মিনিটের সময় সৌদিয়া পরিবহন বাস, যার রেজিঃ- চট্র মেট্রো, ব-১১-০৬৯৮, কোচ নং-৪৬২(এস.সি.এস) এর সিট নং- বি-৪ এ বসে  ঢাকা থেকে মহেশখালীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে মধ্যরাতে মাত্র কয়েক মিনিটে সৌদিয়া বাসের চালকের অবহেলায় বাসসহ দুমড়েমুচড়ে যায় আলালের পরিবারের স্বপ্ন। আর অনিশ্চয়তায় পড়ে যায় ছোট ছোট দুটি বাচ্চার ভবিষ্যৎ।

এখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথাই মনে করছেন আর কাঁদছেন আলাল। কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর ডান পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত কেটে ফেলেছেন চিকিৎসকরা। বাম পায়ের আঘাত এখনও ভালো হয়নি।

তিনি বলেন- গুরুতর আহত হয়ে বেঁচে গেছি আলহামদুলিল্লাহ। কয়েক দফা অস্ত্রোপচারের পর ডান পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত কেটে ফেলে দেন চিকিৎসকরা। এখন পুরোপুরি পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছি।

আহত আলাল আরো জানান- সরকার থেকে শুরু করে যানবাহনের মালিক সমিতি বা ইউনিয়নগুলো কেউই দুর্ঘটনায় আমার পাশে দাঁড়ায়নি। নেই ক্ষতিপূরণের কোনো ব্যবস্থা। সৌদিয়া পরিবহনের সাথে যোগাযোগ করলেও কোনা সাড়া প্রদান করেননি।

আলালের পরিবার জানান- পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম আলাল দুর্ঘটনায় প্রথম পঙ্গু হয়ে উপার্জন হারান। এরপর তার চিকিৎসায় এখন পর্যন্ত প্রায় তিন লাখের অধিক  টাকা খরচ করতে গিয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বন্ধু এবং সহকর্মীদের সহযোগিতায় এখনো চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

এছাড়াও অবুঝ ১০ মাস ও দুই বছরের শিশু দুটির দিকে থাকাতেই আলালের চোখে অশ্রু টলটল করছে। দুই বছরের মেয়ে তাসনিয়া আলালের জিজ্ঞাসা- বাবা তুমি হাঁটবেনা? আলালের প্রত্যাশা বাচ্ছা দু'টির জন্য সে হাঁটতে চায়। হোক সেটি কৃত্রিম পা লাগিয়ে। এ জন্য সে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ প্রত্যাশা করছে। দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং আইনজীবীদের নিকট সহযোগিতার নিবেদন করেন।

ঘটনার বিষয়ে সৌদিয়া পরিবহনকে অভিযুক্ত করে জোরারগঞ্জ থানায় এস.আই মাহফুজের রহমান জানান- এ নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৯৮/১০৫ ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। যার জোরারগঞ্জ থানায় মামলা নং- ৩(০৬)২৩। উক্ত মামলামূলে সৌদিয়া পরিবহনের বাস এবং ট্রাক  জব্দ করলেও ড্রাইভারকে এখনও গ্রেপ্তার করতে পারেননি বলে জানান তিনি।