Advertisement


কক্সবাজারে স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার জেপিটিটিসিতে ভয়াবহ দুর্নীতি, তদন্তে প্রাথমিক প্রমাণ মিলল


মাহবুব রোকন।।
কক্সবাজারের এনজিও সংস্থা স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার মালিকানাধীন জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (জেপিটিটিসি) ঘিরে ভয়াবহ অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে এসব প্রমাণ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

◾তদন্ত কমিটি গঠন

গত ১ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এসেট (Accelerating Skills for Economic Transformation) প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান এবং প্রকৌশলী মো. আকিব বিশ্বাসকে নিয়ে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। শনিবার থেকে তারা মাঠপর্যায়ে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেন।

তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানান, পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের প্রাথমিক সত্যতা তারা পেয়েছেন। তবে পূর্ণাঙ্গ প্রমাণ ও ডকুমেন্ট সংগ্রহের জন্য আরও সময় প্রয়োজন।

◾প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম

কক্সবাজার শহরের আলির জাহাল এলাকার বিএস টাওয়ারের তিনটি ফ্লোরে কার্যক্রম চালায় জেপিটিটিসি। এটি পরিচালনা করছেন সমাজকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) নামের একটি এনজিওর চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা। জেসমিন প্রেমা এই প্রতিষ্ঠান জেপিটিটিসিরও চেয়ারম্যান। অভিযোগ রয়েছে- বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ পাওয়া অর্থের বড় অংশ আত্মসাৎ করছে জেপিটিটিসি কর্তৃপক্ষ, ফলে প্রকল্পের প্রকৃত সুবিধাভোগীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্রশিক্ষণার্থীদের দাবি- নিয়ম অনুযায়ী তিন দিনের প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ৩ হাজার টাকা (খাবার খরচ বাদে), উন্নত মানের ব্যাগ, প্যাড, পেন্সিল, কলম ও এপ্রোন দেওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তাদের হাতে পৌঁছায় মাত্র ১ হাজার টাকা। এ ছাড়াও ফ্রি এই ভর্তি প্রক্রিয়ার কথা গোপন করে অনেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ভর্তির সময়ই অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

প্রশিক্ষণার্থীরা আরও অভিযোগ করেন, শনিবার  তদন্তকালে সেন্টারের কিছু স্টাফ তাদের উল্টো ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখতে চেয়েছে এবং বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে।

◾ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ

শনিবার তদন্তের দিন সকাল থেকে অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ ভুক্তভোগী সেন্টারের সামনে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ জানান। তারা দাবি করেন, সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ নিয়মমাফিক তাদের হাতে পৌঁছায় না। অনেকে বাধ্য হয়ে ফ্রি এ ব‍্যবস্থায় ঋণ করে ভর্তি হয়েছেন, কিন্তু প্রতিশ্রুত সুবিধা পাননি।

◾সাংবাদিকদের উপস্থিতি

তদন্তের খবর পেয়ে সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হন এবং একপর্যায়ে দেখতে পান তদন্ত কর্মকর্তা সবার বক্তব্য না নিয়ে তড়িঘড়ি করে অভিযুক্ত জেপিটিটিসি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে আসছেন। এ সময় উপস্থিত ভুক্তভোগীরা ক্ষুব্দ হয়ে ওঠেন এবং তাদের বক্তব্য গ্রহণের দাবি জানান। পরে বাধ্য হয়ে ভুক্তভোগীদের বক্তব্য নেওয়া হয়।

◾তদন্ত নিয়ে লুকোচুরি 

তদন্তের সময় ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের বক্তব্যগ্রহণ আদর্শ নিয়ম হলেও এ তদন্ত শুরুর আগে কোনো পক্ষকে পূর্বে অবগতি করা হয়নি এবং এক ধরণের গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

◾চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতি

অনিয়মের মূল অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার বিরুদ্ধে। তদন্ত শুরু হওয়ার দিন তিনি অফিসে উপস্থিত ছিলেন না। তবে কিছু কর্মকর্তা–কর্মচারী অফিসে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের বিরুদ্ধেও প্রশিক্ষণার্থীদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ ওঠে।

◾তদন্তের নামে প্রহসন? 

সাংবদিকদের কাছে তথ্য আসে- যে জেপিটিটিসির অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে এ তদন্ত কমিটি গঠন সেই তদন্ত কমিটি সেই প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ব্যবহারসহ তাদের সুবিধা নিয়েই কক্সবাজার সফর করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তা নেমে আসার সময় তাকে বহন করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির একটি মাইক্রো গাড়ি এসে তার সামনে দাঁড়ায়। পরে সাংবাদিকদের দেখে গাড়িটি দ্রুত চলে যায় এবং তদন্ত কর্মকর্তা ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকযোগে স্থান ত্যাগ করেন। তদন্ত টিম কর্তৃক অভিযুক্ত জেপিটিটিসি চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার সাথে আগাম ও গোপন যোগাযোগ এ তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে বলে ওয়াকিবহাল সূত্রগুলোর অভিমত। 

◾প্রকল্পের পটভূমি

সরকারের কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়নাধীন ‘অ্যাকসেলারেটিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন (এসেট)’ প্রকল্পের উদ্দেশ্য দেশের দারিদ্র্য ও বেকারত্ব দূরীকরণ। বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে (২০২২–২০২৬) মোট ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ব্যয় করছে ২০০ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাংক ঋণ সহায়তা দিচ্ছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার।

কিন্তু তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ মিলেছে যে, এনজিও প্রতিষ্ঠান স্কাস চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমার মালিকানাধীন  কক্সবাজারের তালিকাভুক্ত জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে এই বিপুল অর্থ বরাদ্দ নিয়মবহির্ভূতভাবে লুটপাট হচ্ছে।

◾অভিযুক্তদের বক্তব্য 

জেপি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণের অর্থ বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। তিনি তার প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক জায়েদ নূর-এর সাথে যোগাযোগ করার পরমর্শ দেন। যোগাযোগ করা হলে ব্যবস্থাপক জায়েদ নূর এ বিষয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য দেননি। প্রশিক্ষণার্থীদের প্রত্যেককে সবকিছু সঠিকভাবে দেওয়া হয়েছে অন্য প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যান।

◾তদন্ত কমিটির বক্তব্য

তদন্ত কর্মকর্তা প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের আলোকে মাঠপর্যায়ে প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। অনিয়মের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে পুরো বিষয়টি নিশ্চিত করতে আরও নথিপত্র ও ডকুমেন্ট প্রয়োজন।”