Advertisement


যুদ্ধ করেও যোদ্ধা নন কুতুবজোমের সৈনিক কলিম উল্লাহ

পাক হানাদারের বিরুদ্ধে সম্মুুখযুদ্ধ এখন শুধুই স্মৃতি

বিশেষ প্রতিনিধি।।
কলিম উল্লাহ। কক্সবাজারের মহেশখালী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব খোন্দকার পাড়া গ্রামের  বাসিন্দা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযদ্ধের  রুদ্ধশ্বাসের দিনগুলোতে তিনি একজন টগবগে জোয়ান। সে সময় বাংলাদেশ রাইফেল্স এর সদস্য হিসেবে দেশ মাতৃকার জন্য পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বর্তমানে তিনি ৯৪ বছরের অতিশয় বৃদ্ধ। কিন্তু সময়ের নানা মারপ্যাচের কারণে স্বাধীন দেশে তালিকাভুক্ত একজন মুক্তিযোদ্ধা হতে না পারার বেদনাটি জীবনের শেষ বয়সে এসেও তাকে খুব তাড়িত করছে। আলাপকালে তিনি এই প্রতিনিধির কাছে এমন মনোবেদনার কথাই তুলে ধরেন। 

গতকাল সকালে খোন্দাকার পাড়ার বাড়িতে দেখাহয় অতিশয় বৃদ্ধ এই মুক্তিযোদ্ধার সাথে। এসময় তিনি যুদ্ধকালীন নানা স্মৃতিকথা তুলে ধরে আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ওই গ্রামের মরহুম আমির হামজা ও মরহুমা সবেমেহরাজ খাতুনের প্রথম সন্তান কলিম উল্লাহ। এলাকায় তিনি ‘কালামিয়া বিডিআর’ হিসেবে পরিচিত। তিনি জানান শৈশবে লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি তার। লেখাপড়া  জানা না থাকলেও দেশ স্বাধীন করতে হানাদার বদ স্পৃহা ও যৌবন শক্তির উপর ভর করে তিনি এলাকার মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার আব্দুর রহিম (বর্তমানে প্রয়াত) এর সাথে ১৯৪৯ সালে ২৪ জানুয়ারি বিডিআর এর সৈনিক পদে ঢাকার পিলখানায় চাকুরীতে যোগদেন। এখান থেকেই শুরু হয় তার সৈনিক জীবন। তিনি জানান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ঢাকার পিলখানার ১১ নম্বর সেক্টর থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের আক্রমনে শহীদ বাঙ্গালীদের উদ্ধার কাজে অংশ নেন। সে সময় বন্ধ থাকা চন্দ্রঘোনা পেপার মিল পুণরায় চালু করেন এবং সেখানে ২ বছর কাল চাকরি করেন তিনি।

স্মৃতি হাতড়িয়ে তিনি মেজর জেনারেল ওসমানীর যুদ্ধ নির্দেশনার কথা স্মরণে এনে বলেন মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন লক্ষীপুরে পাকিস্তানী সৈন্যরা বাঙ্গালীদের অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় চলন্ত ট্রেন থামিয়ে ১৩ জন বাঙ্গালীকে উদ্ধার করে ঢাকায় নিয়ে যায় বাঙ্গালী বিডিআর জোয়ানরা। এই অপারেশনে অন্যতম সদস্য ছিলেন সৈনিক কলিম উল্লাহ। তিনি আরো বলেন, সিলেটের ৬৯০ ফুট উচ্চতার আদমটিলা থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের বিতাড়িত করে তখন বিডিআর সৈন্যরা তা দখল করে নেন। সেই অভিযানের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন তিনি। তাছাড়া রাজশাহীর সিপাহীর পাড়ায় ক্যাপ্টেন টি.এ বাবর এর অধিনে একাধিক অপারেশনে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

৯ মাসের মুক্তি সংগ্রাম শেষে দেশ স্বাধীন হয়। হানাদার মুক্ত করে দেশ স্বাধীন করবার গর্বে বুক ফুলে ওঠে জনযোদ্ধা কলিম উল্লাহ’র। পরে নিয়ম মত বিডিআরের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। চাকরি ও যুদ্ধে অংশগ্রহণের সমস্ত দলিলপত্র নিয়ে ফিরে আসেন মহেশখালী দ্বীপে মা-বাবার কাছে।

বরাবরই মহেশখালী দুর্যোগ প্রবণ এলাকা। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শুরু হয় দেশে ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রলংকরী ঘূর্নিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস। সেবার জলোচ্ছ্বাস প্রথম এসে হামলে পড়ে বঙ্গোপসাগরের মুখে অবস্থান করা বেড়ীবাঁধহীন খোন্দকার পাড়া গ্রামে। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে গ্রামের প্রায় সকল বসতি। ভেসে যায় সব সহায় সম্পদ। সেবার বাড়িঘর বিলিন হয়ে সাবেক এই বিডিআর সদস্য কলিম উল্লাহর সকল সনদ ও প্রয়োজনীয় দলীলাদি ভেসে যায়। পরবর্তীতে মহেশখালী থানায় এনিয়ে একটি সাধারণ হারানো ডায়রীও করেন তিনি।

অবসরের পর এপর্যন্ত অবসর ভাতা পেয়ে আসছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন এই বিডিআর সদস্য। কিন্তু চিরন্তন সব সত্যগ্রাহ্য এই বিষয়টি এলাকায় প্রচল রইলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘদিন পরে করা রাষ্ট্রীয় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তার নামটি অর্ন্তভুক্ত হয়নি। এনিয়ে জীবনের শেষ বয়সে এসে দুর্ভাগা কলিম উল্লাহ নানা হা-হুতাশ করেই মৃত্যুর দিন গুণছেন।

তাঁর জাতীয় পরিচয় পত্রের তথ্যমতে, ১৯২২ সালের ২৫ ডিসেম্বর  কলিম উল্লাহর জন্ম। সে হিসেবে বর্তমানে তাঁর ৯৪ বছর বয়স। তার নামে ইস্যু করা সরকারের অবসর ভাতা বহির তথ্যমতে তার জন্ম তারিখ ১৩ মে ১৯২৮ সাল। সে হিসাবে বর্তমান পর্যন্ত বয়স দাঁড়ায় তার ৮৮ বছর। তথ্যনুসারে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালে ইদুল ফিতরের সময় উৎসব ভাতা পান তিনি ২২৪ টাকা।

তাছাড়া কলিম উল্লাহর পিপি নম্বর ১৭, টিএস নম্বর ০১, আরপিও-এম-১৭, পেনশন-৯৪৩, প্রসেস নম্বর ১৩-ডি ২৫, ২৮ খানা ২১৩১ বলে জানাগেছে। সেময় সেটেলম্যান্ট অফিসের নোট করা এসব তথ্য অবসর ভাতা বহিতে লিপিবদ্ধ আছে। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অর্ন্তভুক্ত করতে প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে প্রশাসনিক সহায়তা কামনা কছেন তার পরিবারের সদস্যরা।