Advertisement


সব পাখি গাইছে রাসেলের গান


সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু 

আজ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত স্নেহের সর্বকনিষ্ঠ তনয় শেখ রাসেলের ৫৬তম জন্মবার্ষিকী। ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২নং সড়কের ৬৭৭নং বাড়িতে ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর রাতের প্রথম প্রহরে শিশু রাসেল যখন পৃথিবীতে পদার্পণ করে, তখন বঙ্গবন্ধু দলীয় কাজে চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। পুত্রসন্তান জন্মলাভের সংবাদ পেয়ে তিনি চট্টগ্রাম থেকে অতি দ্রুত ঢাকার বাসায় ফেরেন এবং নবজাতককে কোলে নিয়ে নাম রাখলেন রাসেল।

শেখ রাসেল মায়ের পরে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ তনয়া আজকের প্রধানমন্ত্রী ‘হাসু আপা’কে। মা, বাবা, ভাইবোন সবার বড় আদরের রাসেল পরিবারের সবার পরম মমতা ও ভালোবাসা নিয়ে বড় হতে থাকে। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব ছিলেন একজন আদর্শ মাতা ও মহীয়সী নারী। তিনি তার সন্তানদের নৈতিক শিক্ষায় মানুষ করেছিলেন। শিক্ষা দিয়েছিলেন মানবিক গুণাবলির। আনন্দময় শৈশবে রাসেলের দুরন্তপনার মাঝেও মায়ের শিক্ষায় তার মানবীয় গুণাবলির দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। রাসেল অনেক বুদ্ধিমান ও শান্ত প্রকৃতির ছিল। তার মায়াবী চোখের চাহনি আর মিষ্টি হাসি ছিল অসাধারণ। উড়ে বেড়াতে, ঘুরে বেড়াতে শিশু রাসেলের খুব ভালো লাগত। সে সাইকেল চালনায় পারদর্শী ছিল। আর দশজন সাধারণ ছেলের মতো রাষ্ট্রীয় কোনো প্রটোকল ছাড়াই সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যেত।

ছোট্ট রাসেল কবুতর, গরু ও মুরগি পুষতে পছন্দ করত। তার মাছ ধরারও খুব শখ ছিল। ডিম ভাজির সঙ্গে চিনি ছিল রাসেলের প্রিয় খাবার। তার এ ব্যতিক্রমী অভ্যাসটি অনেককে আকৃষ্ট করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী প্রয়াত বেবী মওদুদ ও রাসেলের গৃহশিক্ষিকা গীতালি দাশ গুপ্তার লেখনীতে শেখ রাসেলের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সহোদরা শেখ রেহানা তাদের আদরের ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ‘শেখ রাসেল’ নামের বইয়ে লিখেছেন, ‘রাসেল চলাফেরায় বেশ সাবধানী ও সাহসী ছিল, সহসা কোনো কিছুতেই ভয় পেত না। রাসেলের এমনিতে খাবারের প্রতি অনীহা ছিল, কিন্তু রন্ধনশালায় বাড়ির বাবুর্চি, প্রহরী, গৃহকর্মীরা ফুল আঁকা টিনের থালায় করে যখন সবাই খেত, তখন ওদের সঙ্গে বসত। রন্ধনশালায় পিঁড়ি পেতে বসে লাল ফুল আঁকা থালায় করে তাদের সঙ্গে ভাত খেতে পছন্দ করত।’ এতে বোঝা যায়, শিশুটির মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা কত প্রবল ছিল।

রাসেলের খুব ইচ্ছে ছিল, বড় হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। তাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, বড় হয়ে তুমি কী হবে- সে নির্দ্বিধায় বলত, আমি বড় হয়ে আর্মি অফিসার হব। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাসেলের এ ইচ্ছা মনের মাঝে দানা বাঁধতে শুরু করে। অগ্রজ দুই ভাই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ কামাল ও সেনাকর্মকর্তা শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আসার পর তাদের কাছ থেকে খুব আগ্রহ সহকারে যুদ্ধের গল্প শুনত রাসেল। ১৯৭১ সালে রাসেলের বয়স ছিল ছয় বছর। ওই ছয় বছরের শিশুর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিস্ময়করভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে যখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল, তখন পুলিশের গাড়ি দেখলেই বাড়ির বারান্দার রেলিং থেকে দেখত। তখন তার মধ্যে জাগ্রত দেশপ্রেম দেখা গেছে।


১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। ১৭ ডিসেম্বর যখন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সহায়তায় পরিবারের সঙ্গে বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হলেও বাবাকে না পেয়ে শিশু রাসেলের বুকভরা বেদনা ছিল। যেদিন বাবা ফিরে এলেন, রাসেলের আনন্দ যেন আর ধরে না। পিতা মুজিব জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটানোয় পিতাকে রাসেল খুব কমই কাছে পেয়েছিল। কিন্তু যতক্ষণ পেত, ততক্ষণ তার সবকিছু পিতাকে ঘিরে আবর্তিত হতো। পিতা তাকে এ দেশের শোষিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের গল্প শোনাতেন। মনোযোগী ছাত্রের মতো সে বাবার গল্প শুনত। শিশু রাসেলকে সময় দিতে না পারার বেদনা বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে রাসেলের কথা তিনি অনেকবার তুলে ধরেছেন।

১৯৭৫ সালে শেখ রাসেল ঢাকা ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিল। শিশু রাসেল তার পিতার রাজনৈতিক জীবনকে দেখতে শুরু করেছিল মাত্র। বাবার বুকে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেয়ার শ্রেষ্ঠ সময়টাতেই নরঘাতকদের দল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মহিতুল ইসলামের ভাষ্যমতে, ১১ বছরের শিশু রাসেল প্রতিদিনের মতো সেদিনও ঘুমিয়েছিল। আকস্মিক গুলির শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমভাঙা চোখে সে আতঙ্কিত হয়ে চমকে ওঠে। অবস্থা বুঝে বেগম মুজিব আদরের দুলাল রাসেলকে রক্ষায় বাড়ির কাজের লোকজনসহ পেছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে বলেন। পেছনের ফটক দিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় ঘাতকরা তাকে আটক করে। এ সময় বাড়ির ভেতরে মুহুর্মুহু বুলেটের শব্দ, বীভৎসতা আর আত্মচিৎকার শুনে অবুঝ শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঘাতকদের বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো।’ পরে মায়ের লাশ দেখার পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জোর মিনতি করে বলেছিল, ‘আমাকে হাসু আপার কাছে পাঠিয়ে দাও।’


কিন্তু এতটুকু মন গলেনি ঘৃণ্য নরপিশাচদের। ঘাতকরা এর আগেই বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সব সদস্যকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছে। নরপিশাচদের দল মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বাড়ির দ্বিতীয়তলায় অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় ও পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নিষ্পাপ ও অবুঝ শিশু রাসেলকে মাথায় গুলি করে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিরা শিশু রাসেলকে হত্যা করে বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকারী নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিশ্বের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের নির্মম শিকার হয়ে শিশু রাসেল অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছে, যেখান থেকে কেউ কোনোদিন ফেরে না। শুধু তার কিছু স্মৃতি রয়ে গেছে দুই বোনের মনের গহিনে; যে স্মৃতি তারা বয়ে বেড়াবেন আজীবন।

শেখ রাসেল আজ বাংলাদেশের শিশু-কিশোর-তরুণ, শুভবুদ্ধিবোধসম্পন্ন মানুষদের কাছে ভালোবাসার নাম। অবহেলিত, পশ্চাৎপদ, অধিকারবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত জীবন গড়ার প্রতীক হয়ে গ্রামগঞ্জ ও শহর তথা বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ জনপদে শেখ রাসেল আজ এক মানবিক সত্তায় পরিণত হয়েছে। আজ পৃথিবীতে সব ফুল ফুটেছে রাসেলের জন্য। সব পাখি গাইছে রাসেলের গান। আজ ভোরের বাতাসে ছড়িয়ে দিলাম আমার অন্তহীন শুভেচ্ছা। শুভ জন্মদিন শেখ রাসেল।

অ্যাডভোকেট সালাহ্উদ্দিন আহমদ চৌধুরী লিপু : প্রাবন্ধিক

no-advlipu@gmail.com