Advertisement


মাতারবাড়ি: নীল চ্যানেলে সোনালি স্বপ্ন

মাতারবাড়ি বন্দর। ছবি: অসীম দাশ

নিউজ ডেস্ক।।

 কীভাবে এলো মাতারবাড়ি বন্দর?

মহেশখালীর সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দরের কথা দীর্ঘদিন ধরে শুনা যাচ্ছিল। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক কারণে সেখানে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ থেকে সরে আসতে হয়। কিন্তু এই অঞ্চল যে জ্বালানি শক্তি সম্পদের হাব হতে পারে তা জাপানের স্টাডিতে উঠে আসে। জাপান এই অঞ্চলে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়।

২০১৪ সালের জুনে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে গেলে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী মহেশখালী এলাকার উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আর সেই আগ্রহ থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে জাপান। কিন্তু কয়লাবাহী বড় আকারের জাহাজ ভেড়াতে প্রয়োজন হবে চ্যানেল ও জেটি। কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ, ২৫০ মিটার চওড়া এবং ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর চ্যানেলের প্রয়োজন। সেই অনুযায়ী নির্মাণকাজ ও চলতে থাকে। যেহেতু চ্যানেল নির্মাণ হচ্ছে তাই এই চ্যানেলকে ব্যবহার করে এই এলাকায় একটি বন্দরও গড়ে তোলা সম্ভব বলে জাইকার (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) স্টাডিতে উঠে আসে ২০১৬ সালে। পরবর্তীতে জাইকার সেই স্টাডির ওপর ভিত্তি করে বন্দর নির্মাণের লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ডিটেইল স্টাডি করা হয় এবং এই এলাকায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে তোলা সম্ভব বলে সেই স্টাডিতে উঠে আসে। শুধু কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণাধীন চ্যানেলের সাথে চওড়া আরো ১০০ মিটার বাড়াতে হবে (মোট ৩৫০ মিটার হবে) বলে প্রস্তাবনা করা হয়। আর তাতেই মিলবে গভীর সমুদ্রবন্দর।

অগ্রগতি কতটুকু ?

কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপকরণ আনতে আগামী জানুয়ারিতে জাহাজ ভেড়ার কথা রয়েছে মাতারবাড়িতে। এর অর্থ হলো চ্যানেল প্রস্তুত হয়ে গেছে। এখন শুধু চ্যানেলের চওড়া বর্ধিত করা এবং বন্দরের অবকাঠামো নির্মাণ করা। এজন্য নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মাতারবাড়ি বন্দরের অংশ এবং সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের সড়ক অংশ বাস্তবায়ন করবে। এছাড়া এই প্রকল্পের আওতায় রেলপথ নির্মাণের জন্য দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে। এবিষয়ে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা চকরিয়া থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রেললাইন করছি। এর মাধ্যমে মাতারবাড়ি বন্দরের সাথে রেলনেটওয়ার্ক যুক্ত হবে।’

একই বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে মাতারবাড়ি বন্দরের সাথে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইনের সংযুক্ত হবে। এজন্য আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান রেলওয়ের সাথে যৌথভাবে কাজ করছে। আশা করছি প্রকল্পের মেয়াদকালেই এর কাজ শেষ হবে।’

প্রকল্পের অগ্রগতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাফর আলম বলেন, ‘এই প্রকল্পের ডিটেইলড স্টাডি শেষ। ইতোমধ্যে আমরা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিয়েছি। তারা কাজও শুরু করে দিয়েছে। বন্দর নির্মাণের জন্য ডিটেইলড ডিজাইন, দরপত্র তৈরি এবং নির্মাণকাজ যথাযথভাবে হচ্ছে কি-না সবকিছু মনিটর করবে এই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। আগামী সাত থেকে আট মাসের মধ্যে আমরা ডিটেইলড ডিজাইন পেয়ে যাবো।’

জাফর আলম আরো বলেন, ‘২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হলেও ২০২৫ সালেই কনটেইনার হ্যান্ডেলিং করতে পারবো মাতারবাড়িতে। তবে সড়ক ও রেলওয়ে নেটওয়ার্কের কারণে একটু বিলম্ব হতে পারে, সেজন্য তা ২০২৬ পর্যন্ত ধরা হয়েছে।’

সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ হতে যাওয়া মাতারবাড়ি বন্দর প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায় গত ২০ মার্চ। ৭ মে প্রশাসনিক অনুমোদন পায় নৌ মন্ত্রণালয় থেকে। মাতারবাড়ি বন্দরের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে উল্লেখ করে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘জাইকার স্টাডি এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তির পর দ্রুত এগিয়ে চলছে মাতারবাড়ি বন্দরের নির্মাণ কাজ। আশা করা যাচ্ছে নির্ধারিত সময়ে শেষ করা যাবে।’

কীভাবে পরিচালিত হবে মাতারবাড়ি বন্দর ?

ধলঘাট ও মাতারবাড়ির ১ হাজার ২২৫ একর ভূমিতে গড়ে উঠবে আগামীর সমুদ্রবন্দর। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ২৮৮ একর ভূমি বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এই ভূমিতে প্রথম দফায় দুটি জেটি নির্মাণ করা হবে। এরমধ্যে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি কন্টেইনার জেটি এবং ৩০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি মাল্টিপারপাস জেটি। এই দুই জেটি দিয়েই ২০২৫ সাল থেকে কনটেইনার হ্যান্ডেলিং কার্যক্রমের মাধ্যমে গভীরসমুদ্র বন্দরের সূচনা করতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

মাতারবাড়ি বন্দরের আওতায় দু’টি কী-গ্যান্ট্রি ক্রেন, একটি মাল্টিপারপাস গ্যান্ট্রি ক্রেন, ছয়টি রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন ও তিনটি টাগবোট ক্রয় করার কথা রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জনবল নিয়োগর কার্যক্রম সম্পন্ন করবে।

অপরদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ মাতারবাড়ি থেকে চকরিয়া পর্যন্ত চারলেন বিশিষ্ট ২৭ দশমিক ৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক, ১৭টি  ছোট-বড় ব্রিজ, এক দশমিক ছয় কিলোমিটার ডাইক রোড এবং সার্ভিস রোড নির্মাণ করবে। এই রোডটি চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের সাথে যুক্ত হবে।

বন্দরের স্থাপনা এতো দ্রুত কীভাবে নির্মাণ করা হবে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, ‘আমরা স্টিলের কাঠামো দিয়ে নির্মাণ কাজ করবো। তাই সময় এতো বেশি লাগবে না।’

বন্দরের পরিচালন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ল্যান্ড লর্ড পদ্ধতিতে পরিচালিত হতে যাওয়া বন্দরটি আমরা নির্মাণ করে দিবো এবং পরে কাউকে এর পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হবে।’

কেমন হবে চ্যানেল ?

১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেলটি দিয়ে জাহাজ প্রবেশের পর ইংরেজি অক্ষর ‘টি’ (ঞ) আকৃতির মতো দুটি উইং থাকবে চ্যানেলের। উত্তর প্রান্ত চলে যাবে কয়লা জেটিতে, যেখানে কয়লাবাহী জাহাজগুলো ভিড়বে। দক্ষিণ প্রান্ত চলে যাবে মাতারবাড়ি বন্দরের জেটিতে। কিন্তু বন্দরের জেটিতে যাওয়া জাহাজগুলো চ্যানেলের মধ্যেই ঘুরিয়ে আবারো ফিরতি পথে সাগরের দিকে চলে যেতে পারবে। ৩৫০ মিটার চওড়া চ্যানেলে জাহাজ ঘুরতে পারবে কি-না জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) জাফর আলম বলেন, ‘কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলের চেয়েও বেশি চওড়া মাতারবাড়ি চ্যানেল। আর এই চ্যানেলে বড় আকারের জাহাজগুলো সহজেই ঘুরাতে পারবে। সেভাবেই প্ল্যান করা হয়েছে।’

জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর চ্যানেলে সর্বনি¤œ চওড়া ২৬০ মিটার এবং সর্বোচ্চ চওড়া ৪০০ মিটার পর্যন্ত ।