Advertisement


সোহাগ হত্যাকাণ্ড, বিএনপির আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তা ও ইউনুস সরকারের দায়


এস এম রুবেল

সাম্প্রতিক সোহাগ হত্যাকাণ্ড ঘিরে বিএনপির ভূমিকাকে কেন্দ্র করে নানা সমালোচনা উঠেছে—যা এক অর্থে যথার্থ, তবে সীমিতভাবে দেখলে তা বিভ্রান্তিকর। চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও স্থানীয় দখলবাজিতে যুক্ত একাংশের প্রশ্রয়দান বিএনপির রাজনৈতিক নৈতিকতার অবক্ষয়কেই নির্দেশ করে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার অবকাশ নেই। তবে এটিকে শুধুই ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে, বিএনপির সামনে একটি আত্মশুদ্ধির সুযোগ হিসেবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।

বর্তমানে জনগণ বিএনপির মধ্যে আরেকটি “আওয়ামী লীগ সংস্করণ” দেখতে চায় না। তারা চায় একটি বিকল্প শক্তি—যা ভিন্নমতকে ধারণ করে, অপরাধীকে প্রশ্রয় না দিয়ে রাজনৈতিক পরিশুদ্ধি সাধনে সচেষ্ট হয়। এ প্রেক্ষাপটে, বিএনপির উচিত হবে দলীয় শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের দলে স্থান না দেওয়া। দলগত পরিচয়ের আড়ালে অপরাধীদের নিরাপত্তা দিয়ে বিএনপি নিজেদেরই রাজনৈতিক মূলধন নষ্ট করছে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—এই হত্যাকাণ্ডে কি কেবল বিএনপির দায় নির্ধারণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয়? ক্ষমতাসীন ইউনুস সরকার কি এর দায় এড়াতে পারে?

গত এক বছরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। প্রশাসনিক কাঠামো কার্যত স্থবির। তৃণমূল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় স্তর পর্যন্ত নিরাপত্তা বাহিনীগুলোকে নিষ্ক্রিয় অথবা অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী শুধুই কাগজে-কলমে উপস্থিত, মাঠপর্যায়ে তাদের কোনো বাস্তব কার্যকরিতা নেই। এমনকি পুলিশ বাহিনীও "আধা-নিষ্ক্রিয়" এক অবস্থায় পরিণত হয়েছে। এই অব্যবস্থাপনাই সোহাগ হত্যার মতো নৃশংসতার অনুঘটক।

এ প্রেক্ষাপটে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশকারী এনসিপি ও তাদের সহযোগী ছাত্রসংগঠনগুলো "জুলাই বিপ্লব" ও রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বললেও, বাস্তবে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো অবস্থান নেয়নি। এনসিপি যে ইউনুস সরকারের ছায়াতলে বেড়ে উঠেছে—তা আর গোপন কিছু নয়। ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ দুই উপদেষ্টা সরাসরি সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত থাকলেও, তাদের কর্মকৌশলে জনকল্যাণের কোনো ছাপ নেই। বরং তারা আরও জটিল রাজনৈতিক রসায়নের অংশ হয়ে উঠেছেন।

সম্প্রতি পরিবেশ উপদেষ্টার এক বক্তব্যে সরকার ও এনসিপির সম্পর্কের "অঘোষিত একীকরণ" যেন আরও স্পষ্ট হয়েছে। এনসিপি যদি সত্যিকার অর্থে সংস্কারবাদী রাজনীতির ধারক হতে চায়, তবে ইউনুস সরকারের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে চিহ্নিত করে যথাযথ চাপ সৃষ্টি করাই তাদের দায়িত্ব। ক্ষমতার ছায়ায় অবস্থান করে কেবল বিপ্লবের বুলি আওড়ালে জনসমর্থন পাওয়া সম্ভব নয়।

সবশেষে, জনগণের জীবনের নিরাপত্তাই রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। এই সরকার সে দায়িত্ব পালনে একান্তভাবে ব্যর্থ। বিশেষত স্বরাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টাদের ব্যর্থতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায়। তাদের পদত্যাগ এখন কেবল রাজনৈতিক সৌজন্য নয়, একান্ত প্রয়োজন। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পদের মোহ বড় বাধা। রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক না কেন, পদ আঁকড়ে থাকা এক প্রাচীন সংস্কৃতি—যা রাষ্ট্রের জন্য সর্বাধিক ক্ষতিকর।

পরিশেষে বলবো, দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে এখন আত্মসমালোচনার বাস্তব সুযোগ এসেছে। বিএনপির উচিত হবে দলে শুদ্ধি আনয়ন, অপরাধীদের বিতাড়ন এবং নৈতিক ভিত্তি পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার করা। একইভাবে, ইউনুস সরকারকেও জনগণের নিরাপত্তাহীনতার দায় স্বীকার করে জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায়, এই ব্যর্থতার ভারে দেশ তলিয়ে যাবে, আর জনগণ রাজনীতির ওপর আস্থা হারাবে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট