স্বাধীনতার লাল সূর্যের দিকে চলমান আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য গতি পেয়েছিল এদিন। ইতোমধ্যে পল্টনের এক জনসভায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে পাঠ করে স্বাধীনতার ইশতেহার। রূপিত হয়ে যায় স্বাধীনতার বীজ। স্বাধীনতা সংগ্রাম কিভাবে চলবে, কৌশল কি হবে, কে নেতৃত্ব দিবেন, কিভাবে নেতৃত্ব দিবেন, সমগ্র দেশকে কিভাবে সমরক্ষেত্র করা যায় তার বিবরণসহ ঘোষনা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা।
আমাদের আত্মপরিচয়ের শিরোনামটিও পাওয়া যায় এরমধ্যে। পূর্বেই সিদ্ধান্ত হয়, এ দেশের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’। সিদ্ধান্ত হয় সবুজে ঘেরা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশের জাতীয় পতাকা হবে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা আর ‘জয় বাংলা’ জাতীয় স্লোগান হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল আগেই।
বঙ্গবন্ধুকে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মনোনীত করে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধের সব রাজনৈতিক কৌশল ইতোমধ্যে নির্ধারণ হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু মানুষের মনের ভাষা পড়তে পারতেন। তিনি জানতেন কখন কি বলা উচিত। মানুষ কি চায়। তাদের মনের আকুতি কী? তিনি তাঁর ভাষনে প্রকাশ্যে "স্বাধীনতা" শব্দ উচ্চারণ করেন । জনসভায় বঙ্গবন্ধু ''স্বাধীনতা'' শব্দটি উচ্চারণ করতেই সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে ফেটে পড়ে লক্ষ জনতা। এ যেন হানাদার শাসকগোষ্টির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য যুদ্ধ ঘোষনা।
এদিন সব ঘটনাকে ছাপিয়ে উর্ধ্বে ওঠে আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ। জনগণের প্রতি নতুন আহ্বান আর অধিবেশনে যোগদানের চারটি শর্ত প্রদান প্রদান করেন তিনি। অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত-
১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে
২. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে
৩. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করতে হবে
৪. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
এ চার শর্ত পূরণ করলেই তিনি অধিবেশনে যোগদানের বিষয়ে বিচেনা করবেন মর্মে ঘোষণা দেন। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, রক্তের দাগ শুকায়নি, রক্ত মাড়িয়ে তিনি অধিবেশনে যেতে পারেন না। জনগণ তাকে সে অধিকার দেননি মর্মেও তিনি জানিয়ে দেন।
এদিন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ-
১. বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখুন।
২. সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট- সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হবে।
৩. রিকশা, বেবি, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি এবং রেলগাড়ি ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন। কিন্তু জনগণের ওপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না এবং সেক্ষেত্রে তাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনও কিছু ঘটলে আমি দায়ী হবো না।
৪. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করবেন এবং গণআন্দোলনের কোনও খবর গায়েব করবেন না। যদি তাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না।
৫. শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।
৬. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন।
৭. সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডয়মান রাখুন।
৮. ব্যাংকগুলো প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয়।
৯. অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হইলো। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোনও সময় আবার অংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
১০. স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন।
এদিনের উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের বাঙালি কর্মীদের অসহযোগিতার কারণে বিকালে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার।
সন্ধ্যা ৭টায় বেতার ভবনের সামনে বোমা নিক্ষেপ করা হয়। অপরদিকে জান্তা সরকার এদিন নিয়াজিসহ পাঁচজনকে সহকারী সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করে এক আদেশ জারি করে।