Advertisement


পাঠ পর্যালোচনাঃ ‘সমসাময়িক উৎসে মহিষখালীর ইতিহাস’


মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন

লেখক পরিচিতি-

বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও প্রামাণিক দলিল-দস্তাবেজের আলোকে মহেশখালীর নামকরণ, মহেশখালীতে বসতি স্থাপনের প্রাক-কথন, এ দ্বীপের প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক বর্ণনা, ঐতিহাসিক পরিসংখ্যান, রাজস্ব ব্যবস্থার ইতিহাস, গেজেটিয়ার্স, বাচনিক ও জমিদার প্রথার ইতিহাসসহ ব্যতিক্রমী এ দ্বীপ নিয়ে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য ও প্রামাণিক উৎসের ভিত্তিতে বিশ্লেষণাত্মক তত্ত্ব আর তথ্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনাসহ নির্যাস ও অনুসিদ্ধান্ত দিয়ে পূর্ণতা দান করা করা শিরোনাম বইটি লিখেছেন মহেশখালীর জন্মজাত ইতিহাসবিদ ও গবেষক অধ্যাপক মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী। ডক্টর ছিদ্দিকী মূলত একজন শিক্ষক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে সম্মানসহ এমএ পাশের পর কর্মজীবনের প্রথম দিকে বেসরকারি কলেজ ও ১৯৮৫ সালে তিনি বিসিএস পরিক্ষার মাধ্যমে সরকারি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি ১৯৮৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিশাবে যোগদান করে ২০০২ সালে অধ্যাপক হিশাবে পদোন্নতি পান। ২০২২ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যান। ড. ছিদ্দিকী দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। প্রাচীন বাংলাসহ স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় তিনি বেশ দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত করে নিজের অভিজ্ঞতার ভার বেশ সমৃদ্ধ করেছেন। ইতোমধ্যে তার রচিত ইতিহাস সমৃদ্ধ কমপক্ষে আঠারোটি বই বাজারে এসেছে। সব বই-ই আমার কাছে সম্পদ নয়, সম্পত্তি মনে হয়েছে।

আলোচিত বইয়ের কভার পেজ নিয়ে-
‘সমসাময়িক উৎসে মহিষখালীর ইতিহাস’ বইটি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম প্রকাশ পেয়েছে। বইটি প্রকাশ করেছেন মুহম্মদ নূরুল ইসলাম, সভাপতি, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি, কক্সবাজার। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে উনিশ শতকের মহেশখারীর উচ্চ শিক্ষিত শ্রেষ্ঠ সন্তান (লেখকের ভাষ্য মতে) মাওলানা গোলাম সোলতান রাহিমাহুল্লাহকে। ঢাকা থেকে মুদ্রিত বইটির প্রচ্ছদ করেছেন নিয়াজ চৌধুরী তুলি। গ্রন্থস্বত্ব লেখক কন্যা ডা. রূহ আফজা সাবা। বইটির মুদ্রিত মূল্য ৪৫০/- টাকা। প্রকাশকের ছাড় আছে কমপক্ষে ২৫%। আগ্রহীরা বর্তমানে বইটি কক্সবাজার শহরের এন্ডারসন রোড স্থিত কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীতে পাবেন।

বইটির নির্যাস-
মোট তেরোটি অধ্যায়ে বিভক্ত করে বইটির বিন্যাস করেছেন লেখক মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী। প্রত্যেক অধ্যায়ে ৪ থেকে ১১ টি পর্যন্ত অনুচ্ছেদে বিভক্ত করে আলোচ্য বিষয়ে তত্ত্ব, তথ্য, পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান দিয়ে বইটিকে সমৃদ্ধ করেছেন ড. ছিদ্দিকী। বইটি পড়া শুরু করার আগে পাঠককে অবশ্যই প্রথমে জেনে নিতে হবে লেখক বইটির একটি কাল বিভাজন করেছেন। সেটি ১৭৬০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল। ইতিহাস চর্চার জন্য এটি জটিল প্রক্রিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন ড. ছিদ্দিকী।  ইতিহাস গবেষণার অপরিহার্য অংশ হিশাবে বইয়ে বর্ণিত তথ্যের উৎসের গ্রহণযোগ্যতা অথবা বিশ্বাসযোগ্যতা আনয়নের জন্য লেখক বেশ সচেতনভাবেই প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে দীর্ঘ টীকা ও তথ্য নির্দেশিকা সংযুক্ত করে বইটির তথ্য ও তত্ত্ব সমৃদ্ধ করেছেন। লেখক বইয়ের শুরুতেই ‘মুখবন্ধ’ শিরোনামে একটি ভূমিকা দিয়েছেন। তাতে তিনি চল্লিশ বছর ধরে ইতিহাস চর্চার কথা তুলে এনে বিশ্ব ইতিহাস চর্চা থেকে স্থানীয় ইতিহাস চর্চার ধারা, ক্রম-ধারা, প্রভাব, পদ্ধতি, সংকট, ঝুঁকি ইত্যাদি বিষয়ের একটি নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। এ ভূমিকায় লেখকের পাঠাভ্যাস আর ইতিহাস গবেষণার নিরলস চেষ্টার কথা প্রকটতর হয়েছে।

এ বইয়ের মোট তেরোটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম অধ্যায়টি মূলত ইতিহাস চর্চার ভূমিকা বা প্রাক-কথন বলা যায়। ইতিহাস পাঠ ও চর্চার জন্য এ কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়েছে। পরবর্তী অধ্যায় সমূহকে মহেশখালীর সামগ্রিক ইতিহাসের তথ্য, তত্ত্ব, বিশ্লেষণ, যুক্তি আর অনুসিদ্ধান্ত বললে সম্ভবত বাড়িয়ে বলা হবে না। তারমধ্যে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিল ও প্রমাণক দিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে মহেশখালীর নামকরণ, তৃতীয় অধ্যায়ে বসতি স্থাপন, চতুর্থ থেকে দশম অধ্যায়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যে মহেশখালীর বর্ণনা, পর্যালোচনা ও মতামত, একাদশ অধ্যায়ে বাচনিক ইতিহাস, দ্বাদশ অধ্যায়ে জমিদার পরিবারের বর্ণনা আর শেষ অধ্যায়ে লেখককের নিজস্ব স্পষ্ট মতামত ও উপসংহার টানার পরেও রেশ না কাটানোর জন্য নির্বাচিত গ্রন্থপঞ্জি আর পরিশিষ্টে কিছু প্রামান্য সংযোজন করেছেন।

পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনা-
লেখক প্রথম অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন- ‘উপক্রমণিকা’। তিনি এ অধ্যায়ের প্রথম অনুচ্ছেদে ১৫৬৯ সালে সিজার ফেড্রিক নামক পর্তুগিজের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমাহারে মহেশখালীর সামগ্রিক একটি বর্ণনা তুলে এনেছেন। দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে পরবর্তী অনুচ্ছেদ সমূহে যথাক্রমে ইতিহাস চর্চার গুরুত্বসহ এই বই লেখার যৌক্তিকতা, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, দ্বীপে উন্নয়ন ও পরিকল্পনার গুরুত্ব এবং ইতিহাস গবেষণা পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। এ অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে লেখক পুরো বইটির অধ্যায় পর্যালোচনা নামে একটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করে সমগ্র বইটির সারমর্ম তুলে এনেছেন। যা বইটি পাঠে পাঠককে আগ্রহী করে তুলবে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে- ‘মহিষখালীর নামকরণ’। গুরুত্ব বিবেচনায় এ অধ্যায়ের জায়গা শীর্ষেই থাকবে। প্রথমেই একটি ভূমিকা দিয়ে কোনো স্থানের নামকরণের কারণ, যুক্তি এবং কিসের ভিত্তিতে নামকরণ হয় ব্যাখ্যা করে পরে নামকরণের যৌক্তিকতা, মহেশখালীর নামকরণ নিয়ে লেখার যৌক্তিকতা, মহেশখালীর নামকরণ নিয়ে পরিব্রাজক ফ্রান্সিস বুকানন, উইলিয়াম হান্টার, এইচ. জে. এস কটন, লুইস সিডনী স্টুয়ার্ড ওমেলিদের অভিমত, তারকচন্দ্র দাসগুপ্ত, পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী, ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, ইন্দূভুষণ, অমিয় বসুদের মহেশখালী নামের বানান ও ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করে এ দ্বীপের নামকরণে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও প্রচলিত প্রচলন নিয়ে ব্যাখ্যা ও নিজের অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করেন। এ অধ্যায়ের উপসংহারে লেখক মহেশখালী দ্বীপের নামকরণে নিয়ে বিভিন্ন অভিমত, মতামত, তথ্য, তত্ত্বের ইতি টানেন তার নিজস্ব মতামত দিয়ে। বিজ্ঞ ইতিহাসবিদ ও গবেষক ড. ছিদ্দিকী মহিষ ও খাল শব্দদ্বয় সন্ধিমূলে মহিষখালী হয়েছে মর্মে অনুসিদ্ধান্ত প্রদান করেন এ অধ্যায়ে।

পূর্বোক্ত অধ্যায়ের ন্যায় এ বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি অধ্যায় তৃতীয় অধ্যায়টি। এ অধ্যায়ের শিরোনাম- ‘মহিষখালী দ্বীপে জনবসতি স্থাপনের প্রাথমিক পর্ব’। এ অধ্যায়ের ভূমিকায় লেখক পৃথিবীতে মানব বসতি স্থাপনের ইতিহাস জানার গুরুত্ব তুলে ধরে দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীতে মানব বসতি শুরুর বিশদ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলোতে ১৭৬১ সালের জানুয়ারি মাসে ইংরেজ চিপ হ্যারি ভেরিল্যাস্ট কর্তৃক চট্টগ্রামের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পরই ফিরিঙ্গিঁ কর্তৃক চট্টগ্রাম দখলের কারণে অপমানিত মুসলিম পরিবার কর্তৃক চট্টগ্রামের দক্ষিণ দিকে (মূলত মহেশখালীতে) হিজরত করে বসতি স্থাপন এবং ১৭৮৪ সালে বার্মার তৎকালীন রাজা বোধপায়া কর্তৃক আরাকানের ক্ষমতা দখল করে সেখানের বাসিন্দাদের উপর পাশবিক বর্বরতা, নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে আরাকানিরা কক্সবাজার তথা মহেশখালী দ্বীপে চলে এসে সেখানে বসতি স্থাপন করে স্থায়িভাবে বসবাস করার প্রয়াস পায় বা বাধ্য হয় মর্মে লেখক বিভিন্ন রেফারেন্সসহ যুক্তি তুলে ধরেন। এখানে তিনি ১৭৯৮ সালের ৩০ মার্চ থেকে ০২ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ফ্রান্সিস বুকানন কর্তৃক মহেশখালীতে ভ্রমণ ডায়রীর তথ্যটিও সংযুক্ত করে বসতি স্থাপনের বিষয়টি ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পান।      

লেখক চতুর্থ অধ্যায়টির নাম দিয়েছেন- ‘ফ্রান্সিস বুকাননের বর্ণনা’। ড. ছিদ্দিকী এ অধ্যায়ের শুরুতেই ফ্রান্সিস বুকাননের বিশদ ব্যক্তি পরিচয় তুলে ধরে মহেশখালীতে বুকাননের চার দিনের ভ্রমণের কারণ, ভ্রমণের বিস্তারিত তথ্য অবিকল ইংরেজি ভাষায় এবং বাংলায় অনুবাদ করে চমৎকারভাবে ইতিহাস গবেষণা ও রচনায় তার পারদর্শিতা প্রমাণ করেছেন। এরপরই লেখক বুকাননের বর্ণনার সাথে বর্তমান মহেশখালীর অবস্থা ও প্রেক্ষাপট তুলনা করে অতীত ও বর্তমানের সাথে একটি যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। উপসংহারে লেখকের আক্ষেপ- ‘দুইশত পঁচিশ বছর আগে বুকানন কর্তৃক বৃহত্তর স্বার্থে প্রস্তাবিত কোনো সুপারিশই আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি’। উল্লেখ্য, বুকানন এ দ্বীপ ও দ্বীপের মানুষের স্বার্থে ইংরেজ কোম্পানীকে দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নারিকেলের চাষাবাদ করার এবং মশলা চাষের মতো তিনটি লাভজনক কাজের সুপারিশ করেছিলেন।

‘খান বাহাদুর মৌলভী হামিদুল্লাহ খাঁ’র বিবরণ’- শিরোনাম পঞ্চম অধ্যায়ের। স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতেই লেখক আবারো এখানে শুরুতেই চট্টগ্রামের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী মৌলভী হামিদুল্লাহ খাঁ’র সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম তুলে ধরেন। এই খাঁ ১৮৫৫ সালে আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদকে ইংরেজদের হাত থেকে দখলমুক্ত করে নামাজের জন্য উন্মুক্ত করেন। তার স্ত্রীর সম্পত্তির উপর স্থাপিত এবং তার (খাঁ’র স্ত্রী খাতুন বিবির) নামেই চট্টগ্রামের বিখ্যাত খাতুনগঞ্জ বানিজ্য কেন্দ্র খ্যাতি লাভ করে। ১৮৭০ সালের আগে প্রকাশিত ফারসি ভাষায় হামিদুল্লাহ খাঁ রচিত 'আহাদিসুল হাদিস'ই চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লেখা দ্বিতীয় গ্রহণযোগ্য তাত্ত্বিক বিবরণী। প্রথম ফ্রান্সিস বুকানন। খাঁ’র উক্ত ইতিহাস গ্রন্থে মহেশখালীর প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, জনবসতি, দ্বীপ ইত্যাদির একটি বিশদ বর্ণনা রয়েছে। আমাদের লেখক মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী সে বর্ণনা তুলে ধরে হামিদুল্লাহ খাঁ’র লেখার ভূয়সী প্রশংসা যেমন করেছেন, বিপরীতে খাঁ’র কিছু বর্ণনার ত্রুটি তুলে ধরে সাহসের সাথে সেসবের সমালোচনা করতে এতোটুকু বিলম্ব করেননি। এখানেই একজন প্রকৃত ইতিহাস গবেষকের দৃঢ়তা বলে আমার মনে হয়েছে।

ষষ্ট অধ্যায়ে ‘ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের পরিসংখ্যান’। এ অধ্যায়ের প্রথম দুই অনুচ্ছেদে বহুমাত্রিক প্রতিবার অধিকারী স্কটিস ইতিহাসবিদ স্যার উইলিয়াম হান্টারের পরিচয় তুলে ধরে তার রচিত বই ‘এ্যা স্ট্যাটিক্যাল এ্যাকাউন্ট অফ ব্যাঙ্গল’ থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশ উল্লেখ করে এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এখানেই লেখক হান্টারের বইয়ে বর্ণিত মহেশখালীর সামাজিক, ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক বর্ণনা, দ্বীপে পুলিশি ব্যবস্থা, জনসংখ্যার বিবরণ, যাতায়াত ব্যবস্থা, ধর্ম, ভূমি ব্যবস্থাপনা, সংস্কৃতি, কৃষি, শিল্প ও শিক্ষা ইত্যাদির একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা হাজির করেছেন। এখানে তৎকালীন সোনাদিয়া দ্বীপে মাছের প্রাচুর্যতা, মাছ ধরার বর্ণনার স্বাক্ষাত পাওয়া যায়। সোনাদিয়ায় এক সময় হাঙ্গরের আইস ও পালক শুকিয়ে তা রপ্তানী করা হতো- তা এখানেই জেনেছি আমি।
 
সপ্তম অধ্যায়ের শিরোনাম- ‘কটনের মেমোরেন্ডামে রাজস্বের ইতিহাস’। এ অধ্যায়ে লেখক ভারতীয়দের স্বশাসন প্রদানের পক্ষের একজন বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞ প্রবক্তা এইচ.জে.এস কটনের লিখিত ’নিউ ইন্ডিয়া অর ইন্ডিয়া ইন ট্রানজিশন’ গ্রন্থের রেফারেন্স তুলে এনে মহেশখালীতে রাজস্ব ব্যবস্থার ইতিবৃত্ত বর্ণনা করেন। এই বইয়েই প্রথম বাংলা, খ্রীষ্টিয় এবং মঘী সালের বিবরণ পাওযা যায়। এখানের বর্ণনায় উঠে এসেছে ১৭৬৪ সালের জরিপের ভিত্তিতে ১৭৯৩ সালে দেওয়া চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ও মহেশখালীতে কোনো আবাদী জমি ছিল না। এ অধ্যায়ে ১৭৭৯ সাল থেকে মহেশখালী দ্বীপের জমির পরিমাণ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার বিবরণ পাওয়া যাবে।

পূর্বের ধারাবাহিকতায় অষ্টম অধ্যায়ে লেখক ‘এল.এস.এস ওমেলির গেজেটিয়ার্স’ শিরোনামে এ অধ্যায়ে ওমেলির পরিচয়, তার গেজেটিয়ারে মহেশখালীর প্রাসঙ্গিক বর্ণনা তুলে ধরেছেন। এখানে মহেশখালী দ্বীপের ভৌগোলিক বিবরণের পাশাপাশি বিভিন্ন বিরল জলজ প্রাণীর উপস্থিতির বর্ণনা পাওয়া যায়। কচ্ছপের ডিম সংগ্রহকে একটি লাভজনক শিল্প উল্লেখ করা হয়। ১৮৯৭ সালের প্রচণ্ড জলোচ্ছাসের কারণে ক্ষয়-ক্ষতি, এর ফলে কলেরার প্রাদুর্ভাব, ব্যাপক মানুষের প্রাণহানীর একটি তথ্যবহুল বর্ণনা আছে এখানে। ওমেলির বর্ণনায় দ্বীপে মানুষের বসতি স্থাপনের ইতিহাস, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের উপস্থিতির কথা আছে। আছে সোনাদিয়ার কথাও।

লেখক দশম অধ্যায়ের শিরোনাম করেছেন- ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস গ্রন্থ-প্রবন্ধে মহিষখালী’। এ অধ্যায়ে ড. ছিদ্দিকী শ্রীতারকচন্দ্র দাসগুপ্ত প্রণীত ‘চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত’, শ্রী পূর্ণ চন্দ্র চৌধুরী প্রণীত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে মহেশখালীর ভৌগোলিক অবস্থান ও বিবরণ তুলে ধরেছেন। একই অধ্যায়ে লেখক সংবাদ প্রভাকর সম্পাদক কবি ঈশ্বগুপ্ত প্রণীত ‘জিলা চট্টগ্রামের পুরাতন ও নতুর বিবরণ’ প্রবন্ধ এবং ইন্দূভুষণ দত্ত প্রণীত ’কক্সবাজার’ থেকেও মহেশখালীর ছোট একটি বিবরণ দিয়েছেন। উপসংহারে লেখক যথারীতি তার নিজস্ব আর দৃঢ় মতামত দিয়ে রেখেছেন।

‘বাংলায় ভ্রমণ গ্রন্থে মহিষখালী এবং আদিনাথ’- এটি দশম অধ্যায়ের শিরোনাম। এ অধ্যায়টি মূলত আমাদের দ্বীপের ইতিহাস আর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক আদিনাথ মন্দির নিয়ে লেখা। অমিয় বসু সম্পাদিত ‘বাংলায় ভ্রমণ’ গ্রন্থ থেকে লেখক এখানে বিভিন্ন বর্ণনা তুলে এনে আদিনাথ মন্দিরের বর্ণনা, মন্দিরের ৬৯ টি সোপান, মহেশখালী প্রণালীর বর্ণনা, নাথ দর্শন এবং প্রভাব, আদিনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তী বিবরণ, একাধিক লোককাহিনী, শিবের আগমন ও আদিনাথ মেলা আয়োজনের ইতিহাসের একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা আছে। এখানে আদিনাথ মন্দির প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্য সময় নিয়ে লেখকের নিজস্ব মতামত পাওয়া যাবে। এ অধ্যায়টি যেমন ইতিহাস তেমনটি ঐতিহ্যে ভরপুর। অধ্যায়টিকে আদিনাথ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইতিহাস, শ্লোক, তত্ত্ব এবং তথ্যের সমাহার বললে অবশ্যই বেশি বলা হবে না। এ অধ্যায়ের শেষ অনুচ্ছেদে লেখক আবারো তার সহজাত স্বভাব আর সাহস প্রকাশ করেছেন।
 
‘মহিষখালীর বাচনিক ইতিহাস : নানাবিধ প্রসঙ্গঁ’- শিরোনামে লেখক একাদশ অধ্যায়টি সাজিয়েছেন। এখানে তিনি বাচনিক ইতিহাসের মূল্য এবং প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে কথা শুরু করে আদিনাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রতিষ্ঠাকাল, দ্বীপ উপজেলায় প্রথম মসজিদ স্থাপন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন, বাজার, পান বাজার, চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করেছেন। একই সাথে প্রথম শিক্ষিত, উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তির পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লেখক আমাদেরকে। দ্বীপে এখনো শিক্ষার হার পিছিয়ে পড়ার কারণও পাওয়া যাবে এখানে। এখানে আছে বাঘের বিচরণের কথা। মহাজনী ব্যাবসার আদি-অন্ত বিবরণ আছে এ অধ্যায়ে।

‘মহিষখালীর জমিদার পরিবার’- এটি দ্বাদশ অধ্যায়ের শিরোনাম। মহেশখালীতে জমিদার প্রথার ইতিহাস প্রায় সকলেই জানে। এটি নিয়ে কথা বলে লেখার কলেবর বাড়ানো উচিত মনে করছি না। তবে, ইতিহাস গবেষক লেখক অধ্যাপক ছিদ্দিকী এ অধ্যায়ে মহেশখালীর গণ্ডি পার হয়ে পুরো দেশের জমিদারি প্রথা ও জমিদার পরিবারের একটি বর্ণনা হাজির করে জ্ঞানান্বেষীদের খোরাক মেটানোর চেষ্টা করেছেন। অনুপস্থিত জমিদারের কারণে এখানে উন্নয়নসহ প্রাসঙ্গিক সবকিছু বাধাগ্রস্থ হয়েছে- এটি চমৎকার তথ্য।

শেষ অধ্যায়- ’সারমর্ম ও উপসংহার’। এরকম উপসংহার আগে খুব একটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। শেষে তিনি লিখেছেন- ‘.....এতদসঙ্গে মহিষখালীর সমাজ, সংস্কৃতি, লোকবসতি, লোকাচার, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, প্রবচন, কৃষি, ভূমির বৈশিষ্ট্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রশাসন প্রভৃতি বিষয়ে বহুমাত্রিক ইতিহাস প্রণয়নে আগামী প্রজন্মের ইতিহাস গবেষকদের অনুপ্রেরণা যোগাবে- এটাই প্রত্যাশা। তাছাড়া চলতি প্রচেষ্টায় মহিষখালীর ইতিহাসের যে ভিত রচিত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠবে মহিষখালীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস নামক প্রাসাদখানা’। আমিও এটি বিশ্বাস করতে চাই। এ বিশ্বাস কে ভাঙবে!

আমার অতিরিক্ত কথা-
এ বইয়ের সবচেয়ে বেশি আলোচনাযোগ্য বিষয়ের একটি হলো লেখক প্রচলিত মহেশখালী না লিখে তার সমগ্র গ্রন্থে মহিষখালী লিখেছেন। শিরোনামসহ সব জায়গায় মহিষখালী লিখে তিনি মূলত সমাজে একটি সাহসী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার পাশাপাশি ইতিহাস গবেষণার পদ্ধতি, ধারা ইত্যাদির কাঠামো টেকসই ও দীর্ঘায়িত করেছেন মনে করছি, বিশ্বাসও করছি। তিনি এ গ্রন্থে মহেশখালী দ্বীপের নামকরণ নিয়ে প্রচলিত বিভিন্ন মতবাদ, তত্ত্ব, ধারণা, আলোচনা ইত্যাদি নিজের মতো করে উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে মহিষখালী হয়েছে বলে মতামত প্রদান করেছেন।  বিষয়ের তুলনায় কিছু অধ্যায় আমার কাছে সংক্ষেপিত মনে হলেও তিনি জোরালোভাবে তার মতামত ব্যক্ত করেছেন। এটি লেখকের জ্ঞানের সমৃদ্ধ ভিত্তি বলে আমি মনে করছি, মেনে নিচ্ছি। আমার কাছে এখানে যেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা হলো, তিনি কেবল একটি মতামত ব্যক্ত করার প্রয়াস পেয়েছেন তা নয় বরং তার দিক থেকে শক্ত যুক্তিসহ তা করেছেন। খুব কম ব্যতিক্রম ছাড়া বেশ নির্ভরযোগ্য রেফারেন্স দিয়েছেন। এখন অন্যদের উচিত হবে আরো উন্নত (যদি থাকে) মতামত প্রদানের দিকে এগিয়ে নিয়ে এর কলেবর সমৃদ্ধ করা। এ বইয়ে মহেশখালী দ্বীপ সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণিত হয়নি। এর কারণ- লেখক বইটি লেখার জন্য একটি কাল বিভাজন করেছেন। ইতিহাস চর্চার জন্য এটি জটিল প্রক্রিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ বলে মত দেন ড. ছিদ্দিকী। আর কেউ সেটি করুক। লেখকও সেটি কামনা করেছেন বইয়ের শেষে।

এ বইটি মহেশখালীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থ নয়। লেখক নিজেও এটি দাবি করেননি। তিনি এটিকে ভিত্তি বলেছেন। কতো বিনয়! তবে, প্রয়োজনীয় তত্ত্ব আর তথ্যের ভিত্তিতে এ বইয়ে দ্বীপ মহেশখালীর নামকরণ, বসতি স্থাপন, ভৌগোলিক অবস্থান ও বিবরণ, ফিরিঙ্গিঁ ও রোহিঙ্গা জাতির কথা, জমিদার প্রথা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সভ্যতার ক্রমবিকাশ, দ্বীপের ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান, লোক-কথা ইত্যাদির সমাবেশ ঘটেছে। সন্নিবেশিত হয়েছে মহেশখালী সংশ্লিষ্ট প্রায় তত্ত্ব, তথ্য ও প্রমাণক। লেখক এসব বিশ্লেষণ করেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে, খুরধার যুক্তি দিয়ে। প্রয়োজনীয়  ক্ষেত্রে করেছেন ভূয়সী প্রশংসা আবার তীব্র সমালোচনাসহ এসব তত্ত্ব বা তত্ত্বের অংশ বিশেষ বাতিল করতে সময় নেননি সামান্যও। চমৎকার বিষয় হলো, লেখক তার উত্থাপিত বা আলোচিত প্রত্যোকটি বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রদান করেছেন বেশ দৃঢ়ভাবেই। এটি তাকে পৌঁছে দিবে অনন্য উচ্চতায়। বেঁচে থাকবেন তিনি এ জনপদে, এ সমাজের আলোচনায়। এ কাজটি না করলে লেখকের নিজস্বতা কিছুই থাকে না। এ বইয়ের কলেবর বিস্তৃত হবে একদিন, এ লেখকের হাতেই বা অন্য আরেকজন দ্বীপ সন্তানের হাত ধরে।

মূল্যায়ণ-
এককভাবে মহেশখালীর ইতিহাস নিয়ে এ পর্যন্ত রচিত অন্যান্য বইয়ের তুলনায় এ বইটি আমার কাছে অধিক তথ্য নির্ভর, রেফারেন্স সমৃদ্ধ, উৎস তথ্যে যৌক্তিক ও উন্নত মনে হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ এ জায়গায় যাননি অথবা যাওয়ার জন্য নিজেকে সমর্পণ করেননি। ড. ছিদ্দিকী প্রাপ্তী লাভ বা শর্ত ছাড়ই সেটি করেছেন। ভবিষ্যতের কথা কে বলে রাখে!

বিনয় কামনা-
১) এ লেখায় আমি শব্দের বানানের দিকটি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আলোচিত বই এর আলোকে এবং আমার কথায় বাংলা একাডেমির নিয়ম অনুসরণে করার চেষ্টা করেছি। লেখক সব জায়গায় মহিষখালী লিখেছেন। ওখানে হাত দেওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। প্রচলিত জায়গায় আমি মহেশখালীই লিখেছি, সঙ্গত কারণে।

২) বললাম এ বইটি সবচেয়ে উন্নত, তাহলে এ বইয়ের পাঠ পর্যালোচনা এতোদিন পরে কেনো? আগে দিলে বই মেলা বা অন্যান্য স্থান থেকে সংগ্রহ করতে পারতেন। পড়তে পারতেন। এ কথা আসবে। ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। আমি মাত্র গত কয়েকদিন আগে বইটি পেয়েছি। লেখক সদয় হয়ে দিয়েছেন। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি পেশাগত কারণে। বিলম্বে হলেওতো দিলাম এ বইয়ের খবর। পড়ে নেওয়া কর্তব্য মনে করছি।