Advertisement


অরাত্রিকা | অপূর্ব সাহা


মুশফিকুর রহমান সাহেবের নিশানা বরাবরই অব্যর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের ক্যাডার যখন ছিলেন, কাটা রাইফেল কিংবা পয়েন্ট টু বোর রিভলভারের ট্রিগার টিপেছেন অনেকবার, তার নিশানা প্রতিবার অব্যর্থ হয়েছে কিনা তার হিসাব-নিকাশ এখন আর মনে নেই, আর প্রশ্নটাও তা নিয়ে নয়; আসলে মুশফিকুর রহমানের ‘অব্যর্থ নিশানা’র গল্প নারী আর ক্যারিয়ার ঘিরে। পুরোদস্তুর ছাত্র-রাজনীতির কারণে অনার্সে কিছুটা খারাপ করলেও মাস্টার্সে কোনো রকমের তঞ্চকতার আশ্রয় না নিয়েও তিনি বাংলার মতো একটা ক্রিটিক্যাল সাবজেক্টে ফার্স্ট ক্লাস ছিনিয়ে এনেছিলেন; সেটা কি নিশানা-বিবিক্ত কোনো আকস্মিক লক্ষ্যভেদ? না, টার্গেট ছাড়া তিনি কিছু করেন না। তারপর ঢাকায় আগমন, বাংলা রিসার্চ সেন্টারে উপ-পরিচালক হিসেবে যোগদান, সাহিত্য সেবা, নেতার আদর্শে ফেরা সবকিছু তার একেবারে ‘এক চোখ বন্ধ করে ধনুকে তীর লাগিয়ে ছিলা টেনে নিশানা ভেদ করা’র গল্প।

তবে জাতীয় রাজনীতির আকাশে তাকে উজ্জ্বল নক্ষত্র বলা যাবে না কোনোভাবেই। সত্যি বলতে কী, রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তাকে চর্মচক্ষে কখনও দেখা গেছে কিনা তা নিয়ে মৃত্যুর পর বিস্তর গবেষণা হতে পারে। তবে এ কথা ঠিক যে, নিজেকে অসম্ভব ক্ষীপ্রতায় চ্যানেলাইজ্ড করে একেবারে ‘টপ লেভেল’ পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন। আর এসব যে শুধু তার নিজের জন্য—এমন কথা রহমান সাহেবের চরম শত্রুও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না। তিনি ইচ্ছে করলে কি তার এলাকা থেকে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়ে পার্লামেন্ট সদস্য হয়ে আসতে পারতেন না? ক্যাবিনেট না হয় বাদ, কিন্তু ঐ যে প্রতি বা উপ একটা মন্ত্রী কি তিনি হতে পারতেন না? যারা আছেন, তাদের থেকে কিসে কম যান তিনি? তার রক্তে কি লোহিত কণিকার সংখ্যা কিছু কম আছে অথবা কলজেয় পানি অথবা মগজে ক্ষার—কোথাও আছে কিছু খামতি? আসলে মন্ত্রী হলে প্রাণ খুলে সাহিত্য সেবা করা যাবে না এই চিন্তা থেকেই তিনি ওপথ মাড়াননি।

‘সত্যি কী লাইফ আপনাদের! একটা স্টেট অব আর্টস’র ভেতরে আপনাদের দিন রাত...একটা অলৌকিক আনন্দের ভেতরে কাটান প্রতি পল...’
‘ঐ আনন্দটুকুই তো আমাদের থ্রাস্টিং ফোর্স। এর বাইরে আর কী এমন প্রাপ্তি আছে বলেন...যা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়? লেখকদের চারদিকে শুধু দীনতা...’
মাখনের মতো নরম স্বরে বলল সুষমা দেবী, ‘হুমমম। সেই দীনতা ঘোঁচাতে একটুও যদি কাজে আসতাম, জীবনের একটা অর্থ অন্তত দাঁড় করাতে পারতাম

ফোকলোর নিয়ে গবেষণা করে আকাদেমি পুরস্কার পেয়ে ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। মিনিস্টার হলে সেটা কি জিন্দেগিতে সম্ভব হতো! শুধু দুর্নীতি করা আর তা ঢাকার প্রাণান্তকর চেষ্টার দুষ্টচক্রের মধ্যে খাবি খেতে খেতে জীবনটা পার করা... এই তো একজন মিনিস্টারের লাইফ-সাইকেল। এদেশে মন্ত্রীদের যে জনগণ ভালো চোখে দেখে না, সেটা ভালো মতো জানা আছে রহমান সাহেবের। তবে সাহিত্য হোক, জনগণ হোক, তাদের সেবা করতে গেলে ক্ষমতা একটু-আধটু দরকার আছে। আর সেবা-ধর্ম পালন করার জন্য মাকড়সার মতো কিছু জাল-টাল বুনে, সেই জালের কেন্দ্রে অতঃপর নিরাপদ বসবাস; সেবাও হলো, আবার জালে আটকে পড়া পতঙ্গকুল তার জন্য তো থেকেই গেল উপরি পাওনা হিসেবে।

নারী হচ্ছে রহমান সাহেবের কাছে পতঙ্গবৎ; কারণ পতঙ্গের মতোই তারা একের পর এক আটকা পড়েছে তার জালে। তাদের দ্যুতিময় শরীর নিয়ে খেলেছেন কি না অথবা তাদের মাখনের মতো কোমল মনের রাস্তা ধরে ধারালো বুট পায়ে হেঁটেছেন কি না—সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তাদের সবাইকে তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিয়েছেন, আবার জাল থেকে মুক্তও করে দিয়েছেন। তিনি পারতেন দু’একজন শঙ্খের মতো সাদা আর মখমলের মতো সিল্কি সিল্কি নারীকে আ-জীবন আটকে রাখতে নিজের ক্ষমতার জালে। আটকে রাখার প্রশ্ন কেন—অনেকেই তো আটকে থাকতে চেয়েছে। তার আকাশে লাল-নীল পরীর মতো উড়ে আসা নারীদের শতকরা ৯০ জনই এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুল বাগে আনতে আনতে কিংবা দামি থাইল্যান্ডের ব্রা’র লেস লাগাতে লাগাতে ভালোবাসা-টালোবাসার কথা বলেছে। তা ভালো। ভালোবাসা বেশ ভালো জিনিস। অনেকটা ঐ হোমিওপ্যাথ ওষুধের ঝাঁঝের মতো—জিহ্বায় ফোঁটা পড়ার সাথে সাথে সর্বাঙ্গ কেমন অবশ হয়ে আসে। পরক্ষণেই হাঁটু, কোমর আর কনুই—সব কী রকম এলিয়ে আসে, নির্ভার হয়ে পড়ে, কেমন পাখি পাখি মনে হয় নিজেকে। জীবনে যতবার ভালোবাসা করেছেন রহমান সাহেব, নিজেকে পাখি পাখি মনে হয়েছে। নির্ভার মনে হয়েছে। সুখি সুখি মনে হয়েছে।

আর সেই সুখের অকালমৃত্যু যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে রহমান সাহেব সচেতন থেকেছেন শতভাগ। তাই তো এক শিল্পপতির টেনেটুনে ম্যাট্রিক পাশ একমাত্র কন্যাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছেন। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, জলি বেগমের শরীরের চামড়ায় শঙ্খের সাদা দ্যুতি নেই, অঙ্গে অঙ্গে নেই মাখনের কোমলতা, তবে ঢাকার মতো মেগাসিটিতে জাঁকিয়ে বসার জন্য ধানমন্ডির ঐ সাড়ে তিন কাঠা জমির ওপর দোতলা জৌলুসঅলা বাড়িটার খুব প্রয়োজন ছিল তার। প্রয়োজন ছিল স্থায়ী একটা ভিতের উপর দামি ফোমের কোমলতার। আর সংসার এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রয়োজন ছিল বিশ্বাস এবং সাত কথায় ট্যা-ফ্যা নেই ধরনের একজন স্ত্রীর। সবই ঠিক। তাই বলে নারীদের ব্যাপারে মুশফিকুর রহমান সাহেবকে কেউ কোনোভাবে প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিলে সেটা সহ্য করা কিন্তু তার জন্য খুব মুশকিল। ধর্মীয় বিধিনিষেধের ধারে-কাছে নেই তিনি, পর্দাপ্রথাকে সতীদাহের মতো ঘৃণ্য প্রথা বলেই বিশ্বাস করেন, উইমেন লিবার্টি মুভমেন্টে বাদছাদ দিলেও শতকরা ৮০ ভাগ সমর্থন আছে তার; সমাজে নারীদের দুরাবস্থা দেখে হৃদপিণ্ডের অদূরবর্তী শ্বাসনালীতে মাঝে মাঝে সিমপ্যাথির বাষ্প জমে, বুকটা ভার হয়ে আসে...আহারে! কবে যে নারী-পুরুষ হাতে হাতে রেখে সমানে সমান হয়ে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য জান লড়িয়ে দেবে। 

তবে স্ত্রী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আর কিছু না—একটু সাবধানতা অবলম্বন করেছেন তিনি। ওরকম আলাভোলা সহজ সরল স্ত্রী সিলেকশনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল তার দ্বান্দ্বিক মন। মেলামেশার ক্ষেত্রে তিনি ‘ঝড়ের মতো ছোট’ নীতিতে বিশ্বাসী। তাই চাননি তার সেই ঝড়ো-গতির মুখে কেউ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করুক। আরো একটা ব্যাপার আছে, নিজের স্ত্রী যদি দুম করে অন্যের বিছানায় শুয়েটুয়ে পড়ে, তবে ধকলটা সামলানো তার জন্য কঠিন হবে। তিনি তো ছাত্র-শিষ্যদের প্রায়শই বলে থাকেন, ‘যতটুকু বহন করতে পারবে, ঠিক ততটুকুই বহন করো’; আসলে মানুষের মনের উপর কোনো কথা চলে না। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর ফোক লিটারেচার ঘেঁটে তিনি দেখেছেন চিরায়তকাল ধরেই মানব-মানবীর মন কী বিচিত্র ট্র্যাকে চলে—বাতাসের মতো—এই লঘুচাপ এই গুরুচাপ—কোনো ঠিক ঠিকানা নাই। তা জলি বেগমের বিশ্বস্ততার দেয়ালে চিড় ধরা তো দূরের কথা, ডিসটেম্পারে সামান্য ড্যাম্পও পড়েনি। তবে ট্যা-ফ্যা যে একদমই করে নি তেমন নয়।

তার মাত্রাতিরিক্ত নারীসঙ্গের ব্যাপারে প্রথম দিকে ভাবে-আচরণে কিংবা দু’একটা শব্দ প্রক্ষেপণে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছে বৈ কি। কিন্তু তার অস্বাভাবিক রকমের শীতল দৃষ্টির সামনে সেই প্রতিবাদ ফুঁসে ওঠার বদলে জমে হিম হয়ে গেছে। তবে স্বীকার করতেই হবে, ঐ আলাভোলা সিদেসাদা মানুষটির ভেতরে কিন্তু একটা রোম্যান্টিক মন আছে। সেন্স অব হিউমারও খারাপ না। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে চর্যাপদের কালেকশন ঘেঁটে ভুসুকুপাদের কয়েকটা পদের বাংলা ভার্সন কবে যেন মুখস্থ করে ফেলেছে; আর পরবর্তী ছয়মাস রহমান সাহেবকে স্ত্রীর চর্যাপাঠ শুনতে হয়েছে। বোঝো ঠ্যালা!

আবার রোমান্টিসিজম একেবারে টসটসে; শুক্লাপক্ষের ভরা পূর্ণিমায় তার ছাদে যাওয়া চাই-ই চাই। কিন্তু একলা যাবে না। সন্তানটাকে সাথে নিয়ে যেতে পারে, যাবে না। স্বামী পাশে থাকা চাই, উতল জোৎস্নায় স্বামীসঙ্গে নাকি সব পাপ-টাপ ধুয়ে যায়। এই তার ধারণা। 

একদিনের ঘটনা। বেষ্টনিবিহীন ছাদের কিনারে দুজন দুটো চেয়ারে বসে আগরুম-বাগরুম কথা বলছেন। হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই জলি বেগম প্রায় নিঃশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে রহমান সাহেবের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথায় হাত রাখে। চুলে বিলি কাটে। ঘাড়ে হাত রাখে। তারপর হাতটাকে হঠাৎ সাপের মতো বেঁকিয়ে পুরো গলাটা নিজের অধিকারে নিয়ে বলে ওঠে, ‘আচ্ছা এখন যদি একটা ঠ্যালা দেই, ক্যামন হবে?’ এটুকু কথা। ব্যাস। হিম হয়ে যায় রহমান সাহেবের অন্তরাত্মা; মুহূর্তে চারদিকে নেতিয়ে থাকা জোৎন্সা উৎক্ষিপ্ত জল হয়ে, মারাত্মক ঢেউ হয়ে তার দিকে ধেয়ে আসে। তাকে ঘিরে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকে। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, ঘামও হয়, কিন্তু জোৎস্না-জলের সমুদ্রে মিশে যায় বলে তা দৃশ্যমান হয় না।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। জলি বেগম গলা ছেড়ে দিয়ে হো হো করে হাসতে শুরু করে এবং হাসতে হাসতে গোটা ছাদ পরিক্রমণ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। এই হচ্ছে তার সেন্স অব হিউমারের নমুনা।

ঐ ঘটনার ৭ দিনের মাথায় ছাদের কিনার ঘেঁষে মাথা তোলে ৩ ফুট উঁচু নিরাপত্তা বেষ্টনি।

তবে সুখের কথা হচ্ছে, এর মধ্যে জলি বেগমের সেন্স অব হিউমার আর কখনও জিঘাংসু এনাকোন্ডার মতো তাকে গিলতে আসেনি; এজন্য বিধাতাকে ধন্যবাদ। সংসার হচ্ছে একটা উপাসনালয়ের মতো, দিনরাত ঘণ্টা বাজবে, মন্ত্র উড়বে, হৈ হৈ হবে, রৈ রৈ হবে, কিন্তু সেখানে যুদ্ধ বিগ্রহ কিছুতেই কাম্য নয়।

তবে বলতে দ্বিধা নেই, বিগত ১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে ঐ একটি ঘটনা ছাড়া জলি বেগম উপাসনালয়ের পবিত্রতা নষ্টের কোনো পাঁয়তারা করেনি। একটা যুদ্ধের বাতাবরণ তৈরি করার মতো পর্যাপ্ত আর্মস এবং এমুনিশন মওজুদ থাকা সত্ত্বেও ঐ আলাভোলা টাইপের সহজ সরল অর্ধশিক্ষিত মেয়ে মানুষটি তা ব্যবহারের কোনো চেষ্টাই করেনি। কেন করেনি? নিজের মনেই হেসে ওঠেন মুশফিকুর রহমান। আর্মস এবং এমুনিশনই কি সব? যুদ্ধে মগজ লাগে, কৌশল লাগে—যার একটিও নেই জলি বেগমের।

কতটুকু সময় দিয়েছেন তিনি স্ত্রীকে? ভালোবাসা একপাশে রেখে দিলে সত্য হয়ে ওঠে যে শরীর—তারই বা কতটুকু বিনিয়োগ করেছেন সমাজ-স্বীকৃত সম্পর্কটুকুর উন্নয়নে? চন্দ্রা, মিথুন আর বকুলের জন্ম-প্রক্রিয়ার সাথে তার ন্যূনতম সম্পৃক্ততাটুকু বাদ দিলে স্ত্রীর শরীরের ভূগোল তিনি পড়েছেন যৎসামান্যই। আসলে ভালোবাসা তার আসে না; আসে না বলতে বাঁধভাঙা বানের জলের মতো আসে না। কিন্তু এজন্য তিনি কিছুতেই নিজেকে বিচারের কাঠগড়ায়ও দাঁড় করাতে পারেন না। ভালোবাসার স্রোতধারাকে বিক্ষুব্ধ ঢেউ বানিয়ে তীব্র গতিতে চালিত করে বাঁধ ভেঙে সমতল ভাসানোর জন্য যে আবেগ-শক্তির দরকার তা তাকে বিধাতা দেন নি। আর আজকের শরীর কাল তার কাছে পুরোনো, অনাকর্ষণীয়। কী করতে পারেন তিনি? 

এই যে এখন এক আমলা বন্ধুর বাড়ির পার্টিতে আকণ্ঠ গিলছেন, চারদিকে হাতকাটা ব্লাউজ, ফিনকি দিয়ে উঠছে ফর্সা পেটের নিচে বেপরোয়া চর্বি; কই কোনো ভালোবাসা তো ফিল করছেন না তিনি। তবে এটা ঠিক যে, এই পঞ্চাশেও মাঝে মাঝে তলপেটে ঘাই মারছে দুষ্টু ইঁদুর। পঞ্চাশ শব্দটা মনে হতেই আহ্লাদে আটখান হয়ে গেলেন তিনি। মাথার ভেতর একটা চকচকে ক্রিকেট বল বাতাসে শন শন শব্দ তুলে বাউন্ডারির ওপারে চলে গেল। ফিফটি, নট আউট। গতকাল ৫০তম জন্মদিনে ছোট মেয়ে বকুল বাবাকে একটা কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট নেয়া ছবি উপহার দিয়েছে। তারই ছবি, নিচে লেখা “ফিফটি, নট আউট”। অমূল্য উপহার, সন্দেহ নাই। কিন্তু তিনি সেভেন্টিতেও নট আউট থাকতে চান। ভেতরের আহ্লাদ এবার ঠোঁটের কোলে এসে বাদুরের মতো ঝুলে পড়ে। আর সেই বাদুরের দিকে নজর পড়তেই সুষমা দেবী—সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রী চুম্বাকাকৃষ্ট হয়ে ধেয়ে আসে।

একেবারে বুকের কাছে, ব্লেজারের ব্রেস্টের সাথে পাথর চমকানো শাড়ির আঁচল ছুঁইয়ে বলে, ‘ইউনিক হাসি একটা আপনার ভাই। এওসাম!’
রাশিয়ান ভদকায় একটা চুমুক দিয়ে মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘ওটাই তো আছে বৌদি।’
‘কী বলেন! ইউ আর স্টিল ভেরি রিচ উইথ ইউর আনইউজুয়াল ফিজিক।’
‘লজ্জা দেবেন না, প্লিজ। কাল আমার মেয়েও আমাকে লজ্জা দিয়েছে।’
‘কী রকম? কী রকম?’
‘আমার ছবি প্রিন্ট করে, নিচে ক্যাপশান দিয়েছে, ফিফটি, নট আউট। হা হা হা। গ্রেট জোকস।’
‘ঠিকই তো বলেছে, একটুও বাড়িয়ে বলে নি।’ সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রীর চোখের মণির ভেতর ধেয়ে যাওয়া ক্রিকেটের বল নয়, ব্যাটসম্যানের পেশল শরীর ভাইব্রেট হতে দেখেন মুশফিকুর রহমান।
‘ফিফটি নট আউট।’ কথাটা আওড়াতে আওড়াতে পেছন থেকে ঘুরে সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি দুজনের মাঝখানে এসে বলে, ‘কিন্তু মুশফিক সাহেব আপনার কন্যারত্নটি জানল কী করে আপনার এই নট-আউটের গল্প?’

যদিও প্রশ্নটির ভেতরে একটা প্রচ্ছন্ন খোঁচা ছিল, তথাপি মুশফিকুর রহমান গা করলেন না। কেননা তার জানা আছে, রাতের অ্যালকোহলিক উচ্চারণের কুয়াশা সকালের নন-অ্যালকোহলিক রোদ্দুরে নিমেষে হাপিস হয়ে যাবে। উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন তিনি; হাসিতে পিছিয়ে থাকল না সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারি কিংবা তার স্ত্রী। মুশফিকুর রহমান বুঝতে পেরে গেলেন, বৌদি ক্রিকেট খেলার থেকে ক্রিকেটারদের শরীরের ভাইব্রেশন বেশি পছন্দ করে।

২.
দুপুর পর্যন্ত মেজাজটা ফুরফুরে ছিল। আজ ফেব্রুয়ারির পয়লা তারিখ, বাংলা বইমেলারও পয়লা দিন। মেলা উদ্বোধনের পর, সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রী তার অফিসে ঢুঁ মেরে গেছেন। সামনের চেয়ারে জলপদ্মের মতো ফুটে ছিল ভদ্রমহিলা; কোনো জল ছিল না কোথাও, কিন্তু এক আশ্চর্য ভেজা ভেজা পাপড়ি মেলে ফুঁটে ছিল। সেদিন রাতের অ্যালকোহলিক আলো আর কুয়াশার মিশ্রণে দেখা সুষমা দেবী আজ বাংলা রিসার্চ সেন্টারের একান্ত কক্ষে জানালার কাচ চুঁইয়ে আসা রোদ্দুরে কী রকম টাটকা সব্জির মতো জ্বলছিল। বলল অনেক কথা; বিস্ময়হীন, রোমাঞ্চহীন মনোটোনাস জীবনের একমাত্র আকর্ষণ বই; লোককথার উপরে লেখা মুশফিকুর রহমান সাহেবের গ্রন্থসমূহের ফ্ল্যাপে ছাপানো ছবিগুলো দেখে দেখে তাঁর প্রতি অবসেশন...

‘সত্যি কী লাইফ আপনাদের! একটা স্টেট অব আর্টস’র ভেতরে আপনাদের দিন রাত...একটা অলৌকিক আনন্দের ভেতরে কাটান প্রতি পল...’
‘ঐ আনন্দটুকুই তো আমাদের থ্রাস্টিং ফোর্স। এর বাইরে আর কী এমন প্রাপ্তি আছে বলেন...যা নিয়ে বেঁচে থাকা যায়? লেখকদের চারদিকে শুধু দীনতা...’
মাখনের মতো নরম স্বরে বলল সুষমা দেবী, ‘হুমমম। সেই দীনতা ঘোঁচাতে একটুও যদি কাজে আসতাম, জীবনের একটা অর্থ অন্তত দাঁড় করাতে পারতাম।’

মুহূর্তে বুঝে গেলেন মুশফিকুর রহমান, এই ভদ্রমহিলা সম্পর্কের দূরত্বটুকু খুব দ্রুত পার হয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু তড়িঘড়ি কিছু করা তিনি পছন্দ করেন না; মাছ বড়শি গিললেই ছিপ টেনে তোলার পক্ষপাতী নন তিনি; মাছ বড়শি গিলবে, সুতো ছাড়তে থাকবেন তিনি, মাছ অনেকটা জায়গা নিয়ে জলের ভেতর রুপালি ঝিলিক তুলে ঘুরপাক খাবে, তারপর আত্মসমর্পণ করবে, কোনো উদ্বেগ নেই, উৎকণ্ঠা নেই, নিরুপদ্রব শিকার তিনি থলিতে তুলবেন; আর এটা তো জলপদ্ম; ধীরে সুস্থে তিনি পদ্মপুরাণের প্রতিটি পাতা ওল্টাতে চান।

‘আপনি তো বাংলায় পড়েছিলেন?’ প্রসঙ্গান্তরে গেলেন মুশফিকুর রহমান। ‘চর্যাপদ ক্যামন লাগে?’
‘জাস্ট এওসাম!...টিলাত মোর ঘর, নাহি পরবেশি...। মনে হয় ওটা আমি, হাজার বছরের পুরনো বাংলায় একা একা টিলার উপর ঘর বেঁধে আছি, অপেক্ষা করছি কারো জন্য।’
‘কার জন্য?’
হাসির ঠ্যালায় সুনামি আক্রান্ত সমুদ্র হয়ে গেল সিনিয়র জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রী। বলল চোখে চোখ রেখে, ‘কোনো এক বলিষ্ঠ দেহের কৃষাণের জন্য...’

গুড সিম্পটম, কথায় কথায় দেহ আসতে শুরু করেছে; বিকশিত হতে শুরু করেছে শরীর; এবার দল মেলবে কামজ অন্ধকার: টিলার উপর দুধসাদা পূর্ণিমা নামবে...কদলীঝাড়ের ওপাশে সাঁই করে সরে যাবে বলিষ্ঠ শরীর। এবং কথা সত্যিই সে দিকেই গড়াল।

হাজার বছরের পুরনো কোনো এক রাতে বাংলার কোনো এক নিভৃত টিলার উপর নেমে আসা জোৎস্নার ভেতর জমে উঠল অপেক্ষার গল্প; কামনার গল্প, বাসনার গল্প। গল্পের মাঝখানের বিরতিতে জয়েন্ট সেক্রেটারির স্ত্রীর আইভ্রু’র সঞ্চালন কিংবা ঠোঁটের কোলে বেরিয়ে আসা লোধ্ররেণু মুশফিকুর রহমানকে দারুণ মৌতাতে ঘোর ধরালেও দু’একটা দিন অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেলেন না তিনি। কিন্তু সরস গল্পটা শেষ হওয়ার আগেই কল আসাতে মেজাজ খিঁচে গেল। জরুরি মিটিং। অবেলায় বিদায় দিতে হলো সুষমা দেবীকে।

মেজাজ আরো খিঁচে গেল মিটিং শেষ করে লাঞ্চ সেরে নিজের চেয়ারে বসার পর। টেবিলের ওপর বইয়ের পাহাড় জমে গেছে। বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে সৌজন্য কপি পাঠানো হচ্ছে। ওগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখা দরকার। পিয়ন এসে একটা বইয়ের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে গেল। প্যাকেট ছিঁড়তেই বেরিয়ে এলো দুটো বই। তারই লেখা। তার মানে মেলার প্রথম দিনেই তার বই দুটো আলোর মুখ দেখল। একটি “মিথ ও মানুষ”, অন্যটা “বিশ্বরূপকথায় নারী”। মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু খারাপ হয়ে গেল প্রচ্ছদ দেখে। অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টের নামে আজকাল যা খুশি আঁকছে প্রচ্ছদশিল্পীরা!

বই দুটো একপাশে ঠেলে রাখলেন। ফিফটি নট আউটের মেজাজটা ফিরিয়ে আনা দরকার। বইয়ের স্তূপের দিকে তাকালেন; এইসব বইয়ের ৮০ শতাংশই দুজন লেখকের লেখা। ইউনোকল কিংবা কোয়ার্ন এনার্জি যেমন অয়েল জায়ান্ট, এরাও তেমনি লিটারেচার জায়ান্ট; বাজারে এদের বই চলে অনেকটা কোকাকোলার মতো। মেজাজটা আরো এক ডিগ্রি খিঁচল।

বইগুলো উল্টাতে উল্টাতে একটি বই হাতে এলো, নাম “ফোকলোরিস্ট, লাম্পট্য এবং জানালায় রোদ্দুর”। লেখক অরাত্রিকা। দুটো শব্দের কারণে তিনি বইটার প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ফোকলোরিস্ট এবং অরাত্রিকা। অরাত্রিকা নামটা পরিচিত পরিচিত লাগছে। ফ্ল্যাপ খুঁজলেন, না আছে লেখিকার ছবি, না আছে কোনো লেখক পরিচিতি। স্মৃতি হাতড়াতে শুরু করলেন, নিউরনের এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে লাফিয়ে যেতে যেতে তিনি দেখলেন, শঙ্খের মতো সাদা এক নারী অফিসরুমের উত্তর কোণায় পেতে রাখা সোফায় শরীর এলিয়ে শুয়ে আছে; বিস্রস্ত পোশাক, ওড়না দিয়ে মুখটা ঢাকা...ওয়াও! নওশাদ ইয়াসমিন অরাত্রিকা। এশিয়া ফাউন্ডেশনের চাকরিটা তিনিই তাকে পাইয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটার লেখালেখির হাত তো তেমন ভালো ছিল না। তাতে কী? লেখক হতে ক’দিন লাগে এদেশে? 

প্রথম পাতাটা পড়ার লোভ সমলাতে পারলেন না; আর পড়তে গিয়েই সর্বনাশটা করলেন নিজের। মেজাজের থার্মোমিটারে মার্কারি হু হু করে উঠতে শুরু করল উপরের দিকে। প্রথম পৃষ্ঠার আয়নাতেই নিজের একটা গড়পড়তা চেহারা প্রতিবিম্বিত হতে দেখলেন। ৯২ পৃষ্ঠার বই। বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ খতম দিতে পারলেন বইটা। সেতারা পারভিন নামে এক নারীর জবানিতে লেখা এক অবরুদ্ধ নারীর আত্মজীবনী; ফোকলোরিস্ট স্বামীর বহুগামিতা আর স্ত্রী-বঞ্চনার এক বীভৎস কাহিনী। ফেব্রুয়ারির শীতেও মুশফিকুর রহমান রীতিমতো ঘেমে-নেয়ে উঠলেন। কোট খুলে ফেললেন গা থেকে, টাইয়ের নট ঢিলে করে দিলেন। সবচেয়ে খারাপ সিম্পটম হচ্ছে, হাতের তালু এবং পায়ের তলাটা ঘামছে। জুতো খুললেন, মোজাও খুলে ফেললেন পা থেকে। ...স্বামী একটার পর একটা নারী পরিবর্তন করছে, আর স্ত্রী জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকা এক টুকরো রোদ্দুরের সাথে গল্প বলে বলে পার করছে দিন; তারপর সেই রোদ্দুরকে বিছানায় নিয়ে রাতে শুতে যাচ্ছে এবং রোদ্দুরের সাথে রতিক্রিয়ায় মেতে উঠে নিজেকে ব্যভিচারিণী ভেবে আত্মতৃপ্তি পাচ্ছে এই ভেবে যে লম্পট স্বামীর বিরুদ্ধে একটা প্রতিশোধ নেওয়া গেল...। সবচেয়ে সর্বনাশের বিষয় হচ্ছে, পারিপার্শ্বিককে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে সঠিক নাম ব্যবহার না করলেও যেকোন সচেতন মানুষ বুঝবে ফোকলোরিস্ট মানুষটা আসলে কে।

রিমোট টিপে এসিটা চালালেন মুশফিকুর রহমান। পেটের ভেতর থেকে একটা তেঁতো স্বাদ খাদ্যনালী বেয়ে গলার দিকে ধেয়ে আসছে। অরাত্রিকা এত বড় সর্বনাশ করল কেন তার? ল্যান্ডফোন থেকেই এশিয়া ফাউন্ডেশনে লাইন লাগালেন; অরাত্রিকাকে ধরতে বেশি বেগ পেতে হলো না। ওপাশ থেকে খলবল করে অনেক কথা বলে গেল অরাত্রিকা। ‘রহমান ভাই! মা গো, ক্যামন আছেন আপনি? আল্লা, এতটা সারপ্রাইজড লাগছে না... কয়েকদিন ধরে ভাবছি আপনার চেম্বারে যাব, কিন্তু এত্ত ব্যস্ততা। এবার মেলায় ক’টা বই আসছে আপনার? চুপ করে আছেন কেন? রহমান ভাই বলেন না...’

মনে হচ্ছে ভুল জায়গায় তীর ছুঁড়েছেন। তবু বললেন, ‘তোমার লেখালেখি ক্যামন চলছে?’ এই প্রশ্নটুকু করতেই যেন মুশফিকুর রহমানের রক্ত থেকে কয়েক লাখ লোহিত-কণিকা গা’ব হয়ে গেল।
‘কী যে বলেন, পেটটা উর্বর মানছি, বীজ পড়লেই চাড়া গজায়, সে আপনিও জানেন। কিন্তু এই পেটে বোমা পড়লেও দু’পঙক্তি লিটারেচার আসবে না। হা হা হা।’

এখন রিসিভার ক্রাডলে রেখে দেয়া ছাড়া আর কী করতে পারেন তিনি? কে এই অরাত্রিকা? ফিফটিতে এসে তার জীবনে ঘোর রাত্রি নামিয়ে দিল! কিন্তু এত ভাবাভাবির কী হলো? তার নাম তো কোথাও নেই, যার যা খুশি লিখুক না, কী এসে যায় তার...। কিন্তু ঘাম তো বন্ধ হচ্ছে না। 

অরাত্রিকা কি জলি বেগমের খুব কাছের কেউ—কোনো বন্ধু অথবা আত্মীয়? না, কোনো সম্ভাবনা খুঁজে পেলেন না। এই রকম ইন্টেলেকচ্যুয়াল কোনো বন্ধু কিংবা আত্মীয় জলি বেগমের থাকতে পারে না। তবে কি তার পদচারণায় মুখরিত হওয়া এবং অতীত হয়ে যাওয়া নারী—রানী, কাবেরী কিংবা শেফালিরা কেউ ছদ্মনামে এইরকম ঘোরতর প্রতিশোধ নিল? প্রকাশনা সংস্থায় খোঁজ নিলেই তো উত্তর মেলে। উত্তরা পাবলিশিং হাউজের কর্ণধার ওয়ালী আহমেদের পেটের ভুঁড়ি যতটা বড়, মাথাটা ঠিক ততটাই ছোট। ইচ্ছে করলে ছেলেপুলে পাঠিয়ে মাথাটা দিয়ে ফুটবল খেলানো যায়।

‘ওয়ালী সাহেব, আজকাল কি পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখেন না?’
‘মাথায় কুলায় না স্যার। তয় হেব্বি ট্যালেন্ট একটা পুলা পাইছি, ও-ই তো সব সিলেকশন-ফিলেকশন করে।’
‘ফোকলোরিস্ট, লাম্পট্য এবং জানালায় রোদ্দুর বইটার লেখকের নাম্বারটা দেন।’
‘ক্যান স্যার? কোনো সমস্যা হইছে?’
‘জঘন্য একটা বই। খালি যা তা লিখলেই বই হয়? কোন ছিরি-ছাদ আছে? আরে মিয়া, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতির দিকে খেয়াল রাখবা না...।’
‘স্যার, ঐটা তো ছদ্মনাম। আসল নাম সম্ভবত যেহীন খন্দকার। তরুণ লেখক স্যার...’
‘নাম্বারটা বলেন।’ বিড়বিড় করলেন মুশফিকুর রহমান; কিন্তু আদৌ কি কিছু বললেন? বোধ-বুদ্ধির ওপর কেমন যেন ছ্যাতলা পড়ে যাচ্ছে। মোবাইল নাম্বারটা লিখতে গিয়ে বুঝলেন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সাথে প্রত্যঙ্গগুলোর যেগাযোগে গণ্ডগোল দেখা দিচ্ছে। 
‘আমি কি যেহীন খন্দকারের সাথে কথা বলছি?’
‘কে বলছেন ভাই?’
‘আমি মুশফিকুর রহমান বলছি...’
‘জ্বি না। আমি মাসুদ। একটু আগে মোবাইলটা হাইজ্যাক করে এনেছে আমার ছেলেরা। আপনি বরং কী যেন নাম কইলেন... যেহীন খন্দকারের বাসার ল্যান্ডফোনে ফোন করেন। সরি, আমি এখুনি সিমটা খুলে ফেলে দেব ড্রেনে।’
‘ভাই মাসুদ, যেহীন খন্দকারের বাসার নাম্বারটা দিতে পারবেন?’
‘আপনি তো একটা খোদার খাসিরে ভাই। উনি কি আমার আত্মীয় লাগে নাকি?’ 

ফোন কেটে যায়। বাম দিকে চিনচিন করে ব্যথাটা শুরু হয়। পরবর্তী আধাঘণ্টায় মুশফিকুর রহমান মোট ১৫টি ফোন কল করেন বিভিন্ন নাম্বারে; শেষ কলটি করেন তথ্য প্রতিমন্ত্রীর গোপন নাম্বারে। ‘ভাই আমারে বাঁচান। বইটা ব্যান্ড করেন...ওর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আমার জন্য হার্মফুল।’
তথ্য প্রতিমন্ত্রী খুব মজা পাচ্ছেন এমন কণ্ঠস্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, ‘কিন্তু রহমান সাহেব, কোন অজুহাতে বইটি নিষিদ্ধ করব?’
বিপদে পড়ে গেলেন তিনি; বুকের ব্যথাটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে; বোধবুদ্ধিতে পুরু হয়ে ছ্যাতলা জমে যাচ্ছে; মিন মিন করে বললেন, ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত...’
ওপাশে হাসির তুফান ছুটল। ‘দারুণ অজুহাত বের করেছেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত। আনকোয়েশ্চেনেবল। কেন আঘাত, কিভাবে আঘাত—কেউ কোনো প্রশ্ন পর্যন্ত করবে না? হা হা হা...’

বুকের ব্যথাটা আর সহ্য করতে পারলেন না মুশফিকুর রহমান। পিয়নের উদ্দেশে বেলটা টিপে দিতে না দিতেই চেয়ারের ওপর জ্ঞান হারালেন।

দুদিন পর ঢাকার এক বিখ্যাত কার্ডিয়াক হাসপাতালের আইসিইউতে চোখ মেললেন তিনি। ফগি দৃষ্টিতে রুমের সবকিছু ঢেউয়ের তালে দুলতে থাকলে তার মনে হলো, তিনি এক টুকরো কাঠের ওপর শুয়ে কোনো একটা মহাসাগর ধরে ভেসে চলেছেন; তিনি কি কোনো জাহাজে ছিলেন? জাহাজটা ডুবে গিয়েছিল? তবে ঐ মহিলা কে? কেমন যেন চেনা চেনা মুখখানা... কোন বন্দরে যেন উনার সাথে দেখা হয়েছিল; মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেলেন মুশফিকুর রহমান। 

‘কে আপনি?’ বুকের ভেতর যেন জমে গেছে অনেক জল; গলার স্বরে জল-প্রপাত। ‘অরাত্রিকা।’ মহিলা মৃদু হাসলেন, তারপর ঢেউ হয়ে জলে মিশে যেতে চাইলে, তিনি প্রাণপণে তাকে দৃষ্টির সীমানায় আবদ্ধ রাখার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘আপনাকে কি আমি চিনি? আপনার জন্য ঠিক কোথায় চাকরির তদ্বির করেছিলাম বলেন তো?’ কথার বেগেই বোধ হয়, দৃষ্টি থেকে ঘোলাটে ভাব খানিকটা অপনোদন হলে ঘরের কিছু কিছু জিনিস স্থিরতা পেল, মহিলার মুখটাও। আর ওমনি একটা বিশাল উল্কাপিণ্ড আছড়ে পড়ল মুশফিকুর রহমানের মাথার ভেতরে। ক্যান ক্যান করে উচ্চারণ করলেন, ‘জলি বেগম।’
‘না অরাত্রিকা।’
‘তুমি?’
‘একটা বড় ভুল করে ফেলেছো বইটা নিষিদ্ধ করিয়ে। পথে-ঘাটে ওটা এখন ফেরি করে বিক্রি হচ্ছে। আনন্দবাজার থেকে ওরা যোগাযোগ করেছিল, ভিন্ন টাইটেলে বইটা ওরা ছাপতে চায়। আমি অবশ্য এখনো রাজি হই নি।’
মাথার ভেতরে উল্কাপিণ্ডটা মগজের শিলায় বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ খোদিত করে ঢুকে যাচ্ছে বোধের গহীন ভেতরে। ‘কিন্তু তুমি?’
‘একযুগেরও বেশি সময় আগে ছাদে রেলিং তুলে নিজেকে বাঁচিয়েছিলে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রটাই আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে ভুলে গিয়েছিলে। তোমার লাইব্রেরির চাবি। ঐ চাবি দিয়েই আমি একের পর এক খুলে গেছি আমার মনের ঘরের তালা...’
‘তবে যেহীন খন্দকার কে?’
‘কেউ না। যারাই আমাকে এ কাজে সাহায্য করেছে তারাই যেহীন খন্দকার। আমার খালাত ভাই মাসুদ আমায় সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে।’ রহমান সাহেবের দৃষ্টি ফের ঘোলাটে হতে শুরু করে।