Advertisement


লবণচাষিদের কান্নার শেষ নেই!

তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ আজ বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ নামে পরিচিত। এই পরিচয় বহন করতে পারার পেছনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অনস্বীকার্য। বঙ্গবন্ধু সবসময় কৃষক-শ্রমিকের পক্ষে ছিলেন, মেহনতি মানুষের পক্ষে ছিলেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। যে-কারণে তিনি শেখ মুজিব থেকে "বঙ্গবন্ধু" হয়ে ওঠেছেন। বঙ্গবন্ধু যে সাধারণ কাতারে থাকতে পছন্দ করতেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বাকশাল। বাকশালের অঙ্গ-সংগঠন পাঁচটির মধ্যে জাতীয় শ্রমিক লীগ ও জাতীয় কৃষক লীগ এগিয়ে। তাতে স্পষ্টত বুঝা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু কৃষকের পক্ষে ছিলেন, শ্রমিকের পক্ষে ছিলেন। আজ বঙ্গবন্ধু সশরীরে নেই, তাঁর আদর্শও বিলুপ্তির পথে। এটি জাতির জন্য চরম হতাশার বিষয়।

বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রত্যাশিত দেশে কৃষক-শ্রমিক প্রাধান্য পাওয়ার কথা। কার্যত নামসর্বস্ব কৃষক লীগ এবং শ্রমিক-লীগ ছাড়া আর কিছুই দৃশ্যমান নয়। যদি কথাটি মিথ্যা হয়ে থাকে তাহলে কৃষকের আর্তনাদ দেশ পরিচালনাকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর  পোঁছছে না, কেন? এখানে প্রসঙ্গত বলতে চাই, মহেশখালীর লবণচাষীদের আর্তনাদের কথা, হৃদয় মুচড়ানোর পরেও বেরিয়ে না আসা কান্নার করুণ সুর। বলে রাখি, উন্নয়নের বলি হতে শুরু করেছেন প্রাথমিক অবস্থায় মহেশখালীর কৃষক-শ্রমিক শ্রেণি। অথচ তারাই (কৃষক-শ্রমিক)  ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয়। তাই জাতীয় কৃষক লীগ এবং জাতীয় শ্রমিক লীগই ছিল বাকশালের অঙ্গসংগঠনের প্রথম দিকে। অথচ সেই কৃষকলীগ ও শ্রমিকলীগও মহেশখালীর শ্রমিকের পক্ষ নিচ্ছে না। সম্ভবত সবই কথিত উন্নয়ন খেসারত।

আরও পড়ুন> মহেশখালীর ভূমি অধিগ্রহণ....


বর্তমান যুগ আওয়ামীলীগের জন্য স্বর্ণযুগ বললেও ভুল হবে না। নেই শক্তিশালী কোনো বিরোধী দল, নেই সক্রিয় কৃষক ও শ্রমিক লীগ। কেউ আজ মহেশখালীর দিশেহারা লবণচাষীদের পক্ষে কথা বলছে না। আওয়ামী লীগ যখন হাইব্রিডলীগ দ্বারা আচ্ছাদিত হয়, তখন শ্রমিকের এই করুণদশা হওয়াই কথা। ত্যাগীরা বঞ্চিত হাইব্রিডরা মঞ্চে উপবিষ্ট, বিষয়টা তেমনই। আজকাল আওয়ামী লীগে কর্মী বলতে তেমন কিছু লক্ষ করা যায় না, যা লক্ষ করা যায় সবাই নেতা আর নেতা। যেদেশে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে লাশ বহনের লোক সঙ্কট হয়, জানাজায় হয় ৩৫ জন মুসল্লি; সেদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সরব উপস্থিতি আশা করাও বোকামি। সবাই সুযোগের অপেক্ষায় বসে আছে। কোনো কারণে দলের দুর্দিন চলে এলে নব্য আওয়ামীলীগারদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। তারা এমনিতেই নিরাপত্তার জন্য করোনার যুগে মুখোশের ওপর মাস্ক পরে বসে আছে। যারা দুর্নীতির বিপক্ষে কথা বলে না, জুলুমের বিপক্ষে কথা বলে না, কৃষকের পক্ষে কথা বলে না, তাদের যাই বলা হোক না কেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অনুসারী বলা যাবে না, এটিকু আমি নিশ্চিত। কাজেই বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকেই ভাবতে হবে। বাকিদের ওপর জনগণের ভরসা কম।

যেখানে বঙ্গবন্ধু কৃষক-শ্রমিকদের খাতিরে নিজের জীবন-যৌবন সবই উৎসর্গ করেছেন, সেখানে মহেশখালীর লবণচাষীরা লবণের ন্যায্যমূল্যের কারও কাছ থেকে নিশ্চিত ভরসা পাচ্ছেন না। এটি কি জাতির জন্য করুণ পরিণতি নয়? মহেশখালীতে নামের ওপর কৃষক লীগ আছে, আছে শ্রমিক লীগও। আবার এদের বিরুদ্ধে কক্সবাজার এলএ শাখায় দালালির অভিযোগও রয়েছে। তাছাড়া অন্যান্য আওয়ামী নেতারাও কেন চুপ, সেপ্রশ্নেরও উত্তর মিলছে না। মোটকথা চারিদিক থেকে মহেশখালীর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত। তারা না পাচ্ছে অধিগ্রহণকৃত জমির পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ না পাচ্ছে লবণের ন্যায্যমূল্য।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, মহেশখালীতে লবণের উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ৭ টাকার কিছু বেশি , বিক্রি হচ্ছে ৩ টাকায়। মাঝখানে সুবিধা নিচ্ছে দালাল। ভূমি অধিগ্রহণ শাখায়ও দালালের সুবিধা আর লবণেও পরোক্ষভাবে দালালের সুবিধা। মাঝখানে বঞ্চিত হচ্ছেন মহেশখালীর লবণচাষীরা। এই লবণচাষীদের বেশ কিছু অংশ পানচাষীও। মহেশখালীতে বাস্তবায়নাধীন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব এরই মধ্যে লবণচাষীরা ভোগ করছেন। ক'দিন পরে ভোগ করবেন পানচাষীরা। তারপর হবেন উদ্বাস্তু। লবণের ন্যায্যমূল্য পাওয়া তো দূরের কথা, সম্ভবত ধীরে ধীরে আমরা উদ্বাস্তুকরণের দিকে ধাবিত হচ্ছি। নইলে লবণচাষীদের লবণের ন্যায্যমূল্য দিতে এত বিড়ম্বনা কীসের? লবণের ন্যায্যমূল্য তো কৃষকের প্রাপ্যাধিকার। তা থেকে বঞ্চিত করা মানে লবণচাষে নিরুৎসাহিত করা। ফলে অধিগ্রহণের নামে আগ্রাসন সুবিধা আরও একধাপ এগিয়ে গেল। সম্ভবত সেকারণে লবণে উৎপাদন খরচ প্রতি কেজি ৭ টাকা হলেও কৃষক পাচ্ছেন প্রতি কেজিতে ৩ টাকা।

আরও পড়ুন> মহেশখালীতে উন্নয়নযজ্ঞঃ রূপরেখা...

পাকিস্তান আমলের একটা পরিসংখ্যান যদি আমরা দেখি, তাহলে সেসময়ে কৃষকের ওপর শোষণের সাথে বর্তমানে  মহেশখালীর লবণচাষীর ওপর শোষণের বিবরণ মিলে যায়। মহেশখালীতে সাক্ষরতার হার ৩০% এর এদিক-ওদিক। তাহলে বুঝাই যাচ্ছে মহেশখালী কত পশ্চাৎপদ একটি এলাকা। এখানকার মানুষের জীবিকার অন্যতম উৎস লবণ, পান ও চিংড়ি। আর এই শিল্পগুলোর মধ্যে লবণ-শিল্পের ওপরই চলছে মরার ওপর খড়ার ঘা। আবুল মনসুর আহমদ কর্তৃক লিখিত যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ৫ নং দফায় উল্লেখ আছে, "লবণ তৈরির কারখানা স্থাপন। মুসলিমলীগ মন্ত্রীসভার আমলে লবণ কেলেঙ্কারির তদন্ত ও শাস্তির বিধান "। সেটি ছিল ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশহিতারের একটি দাবি। স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার পরেও আজ লবণের মূল্য বৃদ্ধি তথা ন্যায্যমূল্যের দাবিতে সুর তোলতে হচ্ছে। এটি বড়ই হতাশার এবং আফসোসের বিষয়। মাঠপর্যায় থেকে তথ্যসংগ্রহ করা হলে আলি আসগরসহ আরও অনেকে জানান, ২০১৬ সালে মন প্রতি লবণের মূল্য ছিল ৫০০ টাকারও বেশি, ২০১৭ সালে ৫০০ টাকা, ২০১৮ সালে ৫০০ টাকা, ২০১৯ সালে ১৮০ টাকা, ২০২০ সালে (বর্তমান) মন প্রতি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্যহীন। এভাবে একজন কৃষককে লবণ বিক্রি করতে হলে তাঁকে দেউলিয়া হতে হবে।

পাকিস্তানি শোষকের আরও কিছু পরিসংখ্যান যদি আমরা মিলাই, তাহলে দেখা যায়, পূর্বপাকিস্তানি (বর্তমানে বাংলাদেশ) সরকারি কর্মচারী ১২% (১৯৬২),  সামরিক ক্ষেত্রে ৩.৭% (১৯৫৫), পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পূর্বপাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানা খাতে ব্যয় ৭৩ কোটি রূপি, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ক্ষেত্র এই ব্যয় ২৯৩ কোটি রূপি, পূর্বপাকিস্তানে পাটের মন প্রতি খরচ ১৯ টাকা আর বিক্রি ৩ টাকায়, যা দালালরা বিক্রি করতো মন প্রতি ৪০-৫০ টাকায়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা গম কিনতে পারতেন মণ প্রতি ১৮ টাকায়, একই গম পূর্বপাকিস্তানিদের কিনতে হতো  মণ প্রতি ৩৫ টাকায়। এটি ছিল সেময়ের দৃষ্টান্ত। যা বাংলার জনগণ এখনও ভুলতে পারেনি।

বর্তমানে পুরো কক্সবাজার জুড়ে ৬০ হাজার একরেরও বেশি জায়গায় লবণচাষ হয়। উৎপাদন ১৮ লাখ মেট্রিকটন ছাড়িয়ে গেলেও (পুরো মৌসুম) লবণ উৎপাদনে কেজি প্রতি উৎপাদন খরচ পড়বে ৭ টাকারও বেশি, আর বিক্রি হচ্ছে  ৩ টাকাও কিছু বেশি। তাহলে কেজিতে কমপক্ষে ক্ষতির সম্মুখীন হবেন ৪ টাকা করে। তাহলে লবণশিল্পের মূল্যটাই বা কী? এভাবে ধীরে ধীরে লবণের দাম কমতির দিকে থাকলে লবণ চাষের প্রতি কৃষকেরা উৎসাহ হারাবেন। লবণমাঠ থেকে বিতাড়িত করার এটি একধরনের অপকৌশলও বলা যেতে পারে। যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। অথচ বঙ্গবন্ধু ছিলেন কৃষক-শ্রমিকের জন্য নিবেদিত প্রাণ। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজও কৃষক-শ্রমিকের দুর্দশা ফুরায়নি। লবণের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে চাষিরা চোখের জল ঢালছেন। সত্যিই যেন লবণচাষীদের চোখে লোনাজল। এ জল ফুরিয়ে হাসি ফুটবে নাকি মাঠ ছেড়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে, সেটি প্রায় দেখাই যাচ্ছে। মহেশখালী কথিত সিঙ্গাপুরে পরিণত হয়ে মহেশখালীবাসী আগের তলাবিহীন ঝুড়ির দিকে হাজার মাইল পাড়ি দিল। কথিত উন্নয়ন এবং লবণচাষ এ'দুটি মিলে চোখের লোনাজলই যেন ভাগ্যে জুটলো...!

মুহম্মদ রুহুল আমিন
মহেশখালীর সন্তান, শিক্ষক ও লেখক