Advertisement


রোজিনার মামলার এজাহারে যতো গণ্ডগোল!

রোজিনার মামলার এজাহারের ময়নাতদন্ত ও জামিন খেলা

।। সব খবর পর্যবেক্ষক ।। 

প্রথম আলোর সিনিয়র সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে ১৯২৩ সালের একটি ঔপনিবেশিক আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। রোজিনা ইসলাম বা ঘটনার বিষয়ে কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। এ বিষয়ে সবাই ইতোমধ্যে অবগত হয়েছেন। এখানে যেটা বলতে চাই সেটা হলো মামলার এজাহার ও তৎসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উপ-সচিব কর্তৃক দায়েরকৃত এজাহারে দাবি করা কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্ট হওয়া জরুরী।

এখানে দাবি করা হয়েছে

০১) সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সচিবের একান্ত সচিবের কক্ষে প্রবেশ করেই তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ডকুমেন্ট লুকিয়ে ফেলে এবং তার মোবাইলে ডকুমেন্টের ছবি তোলে।

এখানে প্রশ্ন হলো-রোজিনা ইসলাম শরীরের ঠিক কোন কোন জায়গায় কি কি ডকুমেন্ট লুকিয়ে রাখে তার স্পষ্ট বর্ণনা নাই। তিনি যদি আসলেই অনুরূপ কিছু লুকিয়ে রেখে থাকেন তো এটি স্পষ্ট করা হলো না কেনো? একটি এজাহারে এটি উল্লেখ থাকা খুব প্রয়োজন। কেউ যদি দাবি করে আসলে রোজিনা ইসলাম কিছুই চুরি করেননি, তাহলে কি জবাব আছে বাদীর? এটি কি একটি বানানো গল্প? অনুরূপভাবে রোজিনা ইসলামের মোবাইলে তিনি কি কি ডকুমেন্ট এর ছবি তুলেছেন তারও কোনো বিবরণ নাই। তো এটা বানানো গল্প বললে কি বেশি বলা হবে?

এজাহারে দাবি করা হয়েছে

০২) রোজিনা ইসলাম ডকুমেন্ট চুরি ও মোবাইলে ছবি তোলার পর  উক্ত অফিসে কর্তব্যরত কনস্টবল মিজান দেখে ফেলে। এবং রেজিনা ইসলাম অফিসে কেউ না থাকা অবস্থায় তথায় কি করতেছিল তা জানতে চেয়ে ছবি তুলতে বাধা দেয়।

আমরা জানতে চাই, রোজিনা ইসলাম একান্ত সচিবের কক্ষে প্রবেশের সময় উক্ত কনস্টবল কোথায় ছিল? তিনি রোজিনা ইসলামকে কক্ষে প্রবেশের সময় কেনো বাধা দিলেন না? রোজিনা ইসলামের বোন ও স্বামী রোজিনা ইসলামের বরাত দিয়ে দাবি করেছেন, রোজিনা ইসলাম একান্ত সচিবের কক্ষে প্রবেশের আগে একান্ত সচিবের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নেন। তখন কনস্টবল মিজান তাকে জানান, একান্ত সচিব সাহেব সচিব সাহেবের কক্ষে আছেন এবং রোজিনা ইসলামকে কক্ষে প্রবেশ করে অপেক্ষা করার জন্য বলেন। রোজিনা ইসলাম প্রবেশ করতে না চাইলে কনস্টবল মিজান কোনো অসুবিধা নাই মর্মেও তাকে জানান। দুই পক্ষের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে রোজিনা ইসলামের বোন আর স্বামীর বক্তব্য অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলতে অসুবিধা দেখি না। কারণ, রোজিনা ইসলাম অনুমতি না ফেলে কোনোভাবেই একান্ত সচিবের কক্ষে প্রবেশ করতো না। জোর করে উক্ত কক্ষে প্রবেশ করার কথা অবিশ্বাস্য। আবার চুরি করে প্রবেশ করাও অসম্ভব। কারণ, কনস্টবল মিজান সর্বদাই ঐ কক্ষের দরজার সামনে অবস্থান করার কথা এবং তার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা অনুমতি নিয়েই রোজিনা ইসলাম বা অন্য কারো উক্ত কক্ষে প্রবেশ করার কথা। আসলে বানানো গল্প তো, তাই মিলাতে পারেনি তারা। গল্প বানাতেও একটা যোগ্যতা লাগে। সেটাও তাদের নাই।

এজাহারে দাবি করা হয়েছে

০৩) ঘটনার সময় অতিরিক্ত সচিবসহ একসাথে ০৭ জন কর্মকর্তা একান্ত সচিবের কক্ষে প্রবেশ করে।

তারা তো জানতো না এখানে কি হচ্ছিল? তো তারা একসাথে ০৭ জন এ কক্ষে প্রবেশ করলেন কেনো? কনস্টবল মিজান বা অন্য কেউ তাদেরকে এ সংক্রান্তে খবর দেয় মর্মেও এজাহারে কিছু লেখা নাই। খবর পেলেও খবর পাওয়া মাত্র যে যেভাবে আছে সেভাবেই একান্ত সচিবের কক্ষে আসার কথা। সেক্ষেত্রে একত্রে এতোলোক জড়ো হয়ে একান্ত সচিবের কক্ষে আসার কথা না। তাহলে কি পূর্বেই মিটিং করে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করতে এসেছিল সবাই? মানে কে কি ভূমিকা পালন করবে, কে রোজিনা ইসলামের ব্যাগে ছিনিয়ে নিবে, কে তাত কি ডকুমেন্ট ডুকাই দিবে, কে তার মোবাইল ছিনিয়ে নিবে, কে কোন কোন ছবি তাতে তুলে রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি আর কি।

এজাহারের দাবি

০৪) অতিরিক্ত সচিব রোজিনা ইসলামকে তল্লাশী করে তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট ও ডকুমেন্ট এর ছবি সম্বলিত মোবাইল উদ্ধার করেন।

আচ্ছা, অতিরিক্ত সচিবকে কোন আইনে রোজিনার দেহ তল্লাশী ও তার মোবাইল কেড়ে নিয়ে তা চেক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা যদি জানতে পারি মনে একটু শান্তনা পেতাম। আবার তিনি রোজিনার শরীর বা ব্যাগ তল্লাশী করে বা ঠিক কোন জায়গা তল্লাশী করে কি কি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট উদ্ধার করেছেন যথারীতি তারও কোনো বিবরণ নেই। মোবাইলে কি কি ছবি ছিল তাও বর্ণনা করতে পারেননি (এটি এজাহারে উল্লেখ থাকা অবশ্যই উচিত)। পারবেন কেমনে? তখনো হয়তো ঠিক করতেই পারেননি কি কি দেওয়া যায় রোজিনার ব্যাগে আর মোবাইলে। এ পর্যন্ত যত ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে তার একটিতেও রোজিনার কাছ থেকে কোনো ডকুমেন্ট উদ্ধারের দৃশ্য দেখা যায়নি কিন্তু! তাহলে কি ধরে নিতে পারি? এখানে একটি সূত্র দিয়ে দিই, ঐ অফিসের সিসি ক্যামেরা চেক করে রোজিনার প্রবেশেরে সময়ের পরিবেশ সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা পাওয়া যাবে ( যেমন-রোজিনা চুরি/জোর করে প্রবেশ করেছিল না অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করেছিল)। আবার তার মোবাইলের ছবির ডিটেইলস চেক করে ছবি তোলার সময়ও পাওয়া যাবে। জানা যাবে ছবি গুলো আসলে কখন তোলা? ঐ সাতজন প্রবেশের আগে না পরে? ঐ সাতজন কখন প্রবেশ করলেন তা তো সিসি ক্যামেরাতে আছেই।

এজাহারের দাবি

০৫) একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার শাহবাগ থানার পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে রোজিনাকে জিম্মায় নেন।

একজন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার পদ মর্যাদার (ডিএমপিতে এটি ডিআইজি পদ মর্যাদার) কোনো অফিসার সচিবালয়ে ডিউটিতে থাকেন না। এনারা এতোই শিক্ষিত যে একজন পুলিশ অফিসারের পদ-পদবিও তারা জানেন না। এখানে ডিউটিতে থাকেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার একজন অফিসার। আর পুলিশ জিম্মায় নিল কার কাছ থেকে? অথবা পুলিশ জিম্মায় নিবেন কেনো? পুলিশ তো রোজিনাকে তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছেন। জিম্মা আর উদ্ধার ভিন্ন জিনিস এতো জ্ঞান নিয়ে তারা রাকে ঘুমান কেমনে?

এজাহারের কোথাও বাদি কিভাবে ঘটনা জানলেন তার কোন বিবরণ নেই। যে সাতজন কর্মকর্তা-কর্মচারী একান্ত সচিবের কক্ষে প্রবেশ করলেন সেখানে বাদিও একসাথে প্রবেশ করেছেন বা পরে প্রবেশ করেছেন তার কোনো বিবরণ নেই। তো তিনি ঘটনা জানলেন কিভাবে? এরকম নয়তো-যেভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেভাবেই এজাহার লেখা হয়েছে? এবং তাতেই বাদি স্বাক্ষর করেছেন। তাই যদি না হয়, তাহলে বাদির অবস্থান বা তিনি কিভাবে ঘটনা জানলেন তার বিবরণ নেই কেনো? এটাতো এজাহারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

এজাহারের ভাষ্যমতে, ঘটনা বিকাল ০২.৫৫ ঘটিকার সময়। তো ৫/৬ ঘন্টা রোজিনাকে একান্ত সচিবের কক্ষে আটক রাখার বিধান তারা কোথায় পেলেন? আইন হলো, সাথে সাথে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী পুলিশকে খবর দেওয়া অথবা নিকটস্থ আদালত বা থানায় সোপর্দ করা। তারা সেটি না করে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। রোজিনাকে অবৈধভাবে আটক করে রেখেছেন। রোজিনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের খবরও বলা হচ্ছে। এটি হেফাযতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) আইনে আমলযোগ্য অপরাধ। রোজিনাকে আটকের পর পরই তার পরিবারে বা অফিসে জানাতে হবে। প্রায় তিনঘন্টা পর রোজিনার স্বামী তৃতীয় মাধ্যম থেকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান। এটিও আইনের ব্যত্যয় এবং মহামান্য উচ্চ আদালতের নির্দেশের স্পষ্ট লংঘন। রোজিনাকে সচিবালয়ে দীর্ঘসময় আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। অথচ আইনে এটি নেই। তারা কোনোভাবেই রোজিনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন না। আইন হচ্ছে, তাকে আইনের কাছে সোপর্দ করা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় অবশ্যই তার নিয়োজিত আইনজীবীকে সাথে রাখতে হবে। এটি উচ্চ আদালতের নির্দেশ। অনেকেই দাবি করতে পারে, আইন সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। তাহলে বলার কিছু থাকবে না। কেউ যদি আইনের উর্ধ্বে হয় তার বিষয়ে বলার এখতিয়ার আমাদের নেই।

রোজিনার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে পেনালকোডের ৩৭৯, ৪১১ ধারাসহ ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট এর ৩, ৫ ধারায়। পেনালকোডের ধারাগুলো নিয়ে আলোচনা করার আগে অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট এর ৩ ও ৫ ধারা একটু জেনে নিতে হবে। আলোচিত আইনের ৩ ধারাটি নিম্নরূপ-

ধারা-৩। গুপ্তচর বৃত্তির জন্য শাস্তি-

(১) যদি কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থের পরিপন্থী কোনো উদ্দেশ্যে;

(ক) কোনো নিষিদ্ধ এলাকার নিকট গমন করে, পরিদর্শন করে, অতিক্রম করে সান্নিধ্যে আসে অথবা ভিতরে প্রবেশ করে অথবা

(খ) কোন স্ক্যাচ, প্লান, মডেল অথবা নোট তৈরী করে, যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শত্রুপক্ষের উপকারে আসবে বলে মনে হয়, ধারণা করা যায় অথবা নিশ্চিত হওয়া যায়, অথবা

(গ) যদি কোনো ব্যক্তি শত্রুপক্ষের ব্যবহারে আসতে পারে, আসবে বলে ধারণা করা যায় অথবা নিশ্চিত হওয়া যায়, এমন কোনো অফিসিয়াল গোপনকোড অথবা পাসওয়ার্ড অথবা নোট অথবা অন্য কোনো দলিলপত্রাদি অথবা তথ্য আহরণ করে, সংগ্রহ করে, রেকর্ড করে, প্রকাশ করে অথবা অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট পাচার করে।..................

এ ধারার শর্তই হলো-আসামীর উদ্দেশ্য থাকতে হবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা অথবা স্বার্থ পরিপন্থী। আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো রোজিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এজাহারে এরকম অপরাধ বা অভিযোগের জন্য একটি শব্দও লেখা হয়নি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা স্বার্থের পরিপন্থী কাজের কোনো অভিযোগ ছাড়াই এধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। এটি কেমনে সম্ভব? গায়েবি আদেশে ধারা নাজিল হলে এটি কেনো, আরো কতো কিছুই তো সম্ভব হয়।

আবার এ ধারাতেই আছে নিষিদ্ধ এলাকার ক্ষেত্রে এ ধারা কার্যকর বা প্রযোজ্য। প্রশ্ন আসতে পারে নিষিদ্ধ এলাকা কি? নিষিদ্ধ এলাকার সংজ্ঞাও এ আইনেই আছে। এ আইনের ২(৮) ধারায় বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ এলাকা বলতে সরকার কর্তৃক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষিত কোনো নিষিদ্ধ এলাকা। এ ধারাতেই নিষিদ্ধ এলাকার সুষ্পষ্ট উদাহরণ দেওয়া আছে। তাতে একান্ত সচিবের কক্ষ তো নয়ই, সচিবের কক্ষও নিষিদ্ধ এলাকা নয়। প্রত্যেক আইনের মতোই এ আইনেরও একটা উদ্দ্যেশ্য আছে। আর এ উদ্দ্যেশ্যটি হলো, গুপ্তচরবৃত্তি রোধ করা। মূলত সামরিক, কূটনৈতিক, যুদ্ধ সংক্রান্ত তথ্য আর ডকুমেন্ট পাচার ঠেকাতে এ আইন করা হয়েছিল। অতএব, রোজিনা কোনো নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করেছেন, এটা আইনগতভাবে বলা যাবে না। আবারো প্রশ্ন করা যায়, তাহলে কেনো এ ধারায় মামলা হলো? জবাব কে দিবে?

অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট এর

ধারা ৫। (১) কোনো নিষিদ্ধ এলাকা ও সরকার ঘোষিত কোনো এলাকা সম্পর্কীয় কোনো গোপনীয় অফিসিয়ালকোড বা পাসওয়ার্ড বা  কোন স্ক্যাচ, মডেল আর্টিকেল, নোট, দলিলপত্রাদি অথবা তথ্যাদি কোনো ব্যক্তি আইনসঙ্গতভাবে দখলে বা নিয়ন্ত্রণে থাকলে-

(ক) সে যদি তা ইচ্ছাকৃতভাবে, আইনগত অধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তি বা আদালতের নিকট বা রাষ্ট্রের স্বার্থে অন্য কোনো ব্যক্তির নিকট ব্যতিত অন্য কোনো ব্যক্তিরি নিকট হস্তান্তর করে অথবা

(খ) তার নিয়ন্ত্রণাধীন তথ্যাদি অন্য কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের শক্তির স্বার্থে বা দেশের নিরাপত্তার পরিপন্থীমূলকভাবে ব্যবহার করে অথবা

(গ) আইনগত অধিকারের মেয়াদ শেষেও যদি নিজের অধিকারে রাখে বা

(ঘ) যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ফেরত প্রদানের বা হস্তান্তরের নির্দেশ পালন না করে অথবা তা সংরক্ষণে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন না করে বা নিজেই উহার নিরাপত্তা পরিপন্থী কাজ করে

(ঙ) তাহা হলে সে এ ধারার অপরাধে অপরাধী হবে।

এ ধারারও প্রধান শর্ত এলাকাটি নিষিদ্ধ হতে হবে এবং আলোচিত ডকুমেন্ট কারো আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ মানে যিনি উহার দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তি। যা দ্বারা সাধারণ অর্থে সংশ্লিষ্ট অফিসের লোককেই বুঝাবেন। মানে সরকারি কর্মচারী। নিষিদ্ধ এলাকা নিয়ে আগেই বর্ণনা করেছি। রোজিনা এ ধারার অপরাধ করার সুযোগ নেই। পেনালকোডের ধারা নিয়ে আর আলোচনা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি না। এটি অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, পেনালকোডের ৩৭৯ ধারা হলো চুরির অপরাধ। রোজিনা যদি ডকুমেন্টস চুরি করেও থাকে সেটা অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট এর বর্ণিত ধারায় কভার করে। একই অপরাধের জন্য একই মামলায় দুইটি ধারা প্রয়োগ বিধিসম্মত নয়। আবার পেনালকোডের ৪১১ ধারা হলো চোরাই মালামাল হেফাযতে রাখা। জব্দ তালিকা অনুযায়ী রোজিনার কাছ থেকে অনুরূপ কোনো মালামাল উদ্ধার করা হয়েছে সেটা উল্লেখ নাই। সেক্ষেত্রে রোজিনার বিরুদ্ধে এ ধারার অভিযোগ আনা অবান্তর ও কাল্পনিক। 

আমাদের সংবিধান মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নিশ্চয়তা দেয়। এ মামলা তা রোধ করতেছে। আইনটি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং ১৯২৩ সালের একটি পুরাতন আইন। কোনোভাবে বিরোধ হলে সকল আইনের উপর সংবিধান প্রাধান্য পাবে এ নীতিতে সংবিধান বলবৎ হওয়ার পর (১৯৭২ সালের ৪ ঠা নভেম্বরের পর) এ আইনের কার্যক্রম কোনোভাবেই চলতে পারে না।

আরেকটা কথা আলোচিত ডকুমেন্টস যদি এতোই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয় তো তা একান্ত সচিবের কক্ষে তাও যে কেউ কক্ষে প্রবেশ করলেই পেয়ে যাবে এরকম অবস্থায় থাকবে কেনো? এটিতো মন্ত্রী মহোদয় বা সচিবের নিয়ন্ত্রণেই থাকার কথা। তাও খুব সিক্রেট জায়গায় লক করা অবস্থায়। তো যদি ধরে নিই এখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল ছিল, তাহলে যিনি এসব দলিল উন্মোক্ত অবস্থায় রেখেছেন তার কি কিছুই হবে না? অফিসিয়াল সিক্রেটস এ্যাক্ট এর ধারা ৫(ঘ) তে কিন্তু একথাই বলা আছে। আবার বলতে হচ্ছে একান্ত সচিবের কক্ষ আইনগতভাবে কোন নিষিদ্ধ কক্ষ নয়।

জামিন খেলা-

প্রায় ৬ ঘন্টা অবৈধ আটক রাখার পর রোজিনাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তারপর আরো অনেক পরে মামলা দায়ের। পরদিন আদালতে উপস্থাপন। রিমান্ডের আবেদন শুনানী করে নামঞ্জুর করলেও এদিন রোজিনার জামিন শুনানী করেননি আদালত। বৃহস্পতিবার শুনানী করলেন। আদেশ দিবেন রবিবার। যে আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে সে আইনেই বলা আছে এটি জামিনযোগ্য অপরাধ। জামিন দিতে অসুবিধা নাই। তাছাড়া, ফৌজদারি কার্যবিধি ৪৯৭ ধারা মতে- মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ অপরাধী হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি ষোল বছরের কম বয়স্ক, স্ত্রীলোক বা অসুস্থ হলে আদালত তাকে জামিনে মুক্তির নির্দেশ দিতে পারবেন। রোজিনা স্ত্রীলোক এবং অসুস্থ্য এটা নিয়ে সম্ভবত কারো দ্বি-মত নাই। জামিন পাওয়া তার অধিকার। তাছাড়া জামিন না পাওয়ার মৌলিক তিনটি উপাদান বিবেচনা করলেও রোজিনা জামিন পায়। অভিযুক্ত তখনই জামিন পাবে না, যদি অভিযুক্ত জামিন পাওয়ার পর চিরতরে পলাতক হওয়ার সম্ভবনা থাকে, মামলার তদন্তে প্রভাব বিস্তার করে স্বাক্ষ্য-প্রমাণ বিনষ্ট করে এবং পুণরায় একই অপরাধ করে। তিনটির একটিও রোজিনার করার ক্ষীণতর সম্ভাবনাও নাই। অর্থাৎ রোজিনার জামিন না মঞ্জুর হওয়ার কোনো কারণ নাই।

আইনের স্বাভাবিক দর্শন ও সাংবিধানিক চেতনা দ্রুত বিচার ও প্রকাশ্য প্রতিকার দাবি করে। জামিন শুনানির আদেশ ঘোষণার ক্ষেত্রে স্পষ্ট যৌক্তিক কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে অতিরিক্ত সময় নেওয়া সেই চিরায়ত দর্শন ও চেতনার পরিপন্থী। কারণ, জামিনের আবেদন নিষ্পত্তির আদেশ রায় ঘোষণার মতো কোন বিষয় নয় যে, সাক্ষ্য পর্যালোচনাপূর্বক বিচারকের সময়ের প্রয়োজন হবে। জামিন পাওয়া এবং দ্রুততম সময়ে পাওয়া অভিযুক্তের স্বাভাবিক আইনি অধিকার, বঞ্চিত হওয়াটাই বরং ব্যতিক্রম। তদুপরি নারী ও অসুস্থ অভিযুক্তের ক্ষেত্রে জামিন পাওয়া একটি আইনি অগ্রাধিকার। জামিনের আবেদন যেহেতু প্রকাশ্যে করা হয়েছে- প্রকাশ্য আদালতেই দ্রুততম সময়ে সেটির নিষ্পত্তি হওয়া প্রত্যাশিত। সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রকাশ্য আদালতে বিচারলাভ এবং দ্রুত বিচারলাভ প্রতিটি অভিযুক্তের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার। যুক্তিসঙ্গত কারণ ব্যতীত জামিন আবেদন নিষ্পত্তির বিচারিক বিলম্ব ন্যায়বিচারকে অস্বীকারের নামান্তর। কারণ, আইনবিজ্ঞানের প্রাথমিক পাঠের একটি হচ্ছে- 'Justice Delayed is Justice Denied'।

নিম্ন আদালতের বিচারক কৃত এই ধরণের আইনগত বিচ্যুতির ক্ষেত্রে ভারতের উচ্চ আদালতের বিচারিক হস্তক্ষেপের একাধিক উজ্জ্বল নজির রয়েছে। যার মধ্য দিয়ে আইনের শাসনের অনন্য দর্শন মূর্ত হয়ে ওঠে। অধস্তন আদালতের বিচারক কর্তৃক জামিন আবেদন নিষ্পত্তির বিলম্বের ঘটনা দৃষ্টিগোচর হলে ২০০৯ সালে বোম্বে হাইকোর্ট অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দশ্যে একটি সার্কুলার (circular no.A.1211/2009) জারি করে 'as expeditiously aspossible' জামিন আবেদন নিষ্পত্তির নির্দেশনা প্রদান করেন। একই সালে Rasiklal vs Kishore [(2009) 4 SCC 446] মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন যে, জামিনযোগ্য মামলায় জামিন দাবি করা ও তাৎক্ষণিক জামিনলাভ করা অভিযুক্তের একটি পরম (absolute) ও অলঙ্ঘনীয় (indefeasible) অধিকার। ২০১৯ সালে কেরালার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে সন্তোষ কুমার নামের এক ব্যক্তি জামিন আবেদন করলে বিজ্ঞ বিচারক দুই সপ্তাহ বিলম্বের পর সেই আবেদন নিষ্পত্তি করেন। বিষয়টি কেরালা হাইকোর্টের দৃষ্টিগোচর হলে আদালত এই বিলম্ব অযৌক্তিক ঘোষণা করেন এবং এই মর্মে আদেশ প্রদান করেন যে, প্রতিটি জামিন আবেদন শুনানির দিনে অথবা পরদিনে অবশ্যই নিষ্পত্তি করতে হবে, এছাড়া, জামিন আবেদনের উপর ঘোষিত আদেশের কপি ঘোষণার দিনেই আবেদনকারীকে হস্তান্তর করতে হবে। S.K. Hyder v. The State of Odisha (2019) মামলার রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন- 'Delay in Disposal of Bail Application is Travesty of Justice'।

শেষ কথা, জামিন আবেদনের বিলম্বিত ও অপ্রকাশ্য নিষ্পত্তি জামিন প্রার্থীর ন্যায়বিচার প্রাপ্তির প্রতিবন্ধক, আইনের শাসন ও সংবিধানের চেতনার সাংঘর্ষিক, জামিন আবেদন নিষ্পত্তিতে অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণ ন্যায়বিচারকে পরাহত করে। স্মরণ রাখা কর্তব্য- বিচারিক ইচ্ছাধীন ক্ষমতার চর্চা যুক্তিসঙ্গত হওয়ার শর্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এ সংক্রান্ত ভারতীয় বিচারিক দর্শন বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় অনুকরণীয় হতে পারে।

তারপরও জামিন নিয়ে খেলা চলতেছে।