Advertisement


কথিত প্রেমিকা রোহিঙ্গা তরুণীকে খুন করে মহেশখালী চলে এসে ভয়ংকর রূপ নেয় সোলেমান


এস এম রুবেল।। মহেশখালীতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া মাহিয়া নামের এক শিক্ষার্থীকে। এ ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর ভীতির সঞ্চার হয়েছে অন্যান্য অভিভাবকদের মাঝে। তারা নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন।

যেভাবে নিখোঁজ হয় মাহিয়াঃ
৩০ নভেম্বর প্রতিদিনের ন্যায় বাড়ি থেকে মাতারবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণ সাইরার ডেইল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় মাহিয়া। সেখান থেকে স্কুল ছুটি শেষে বেলা ১২ টার দিকে বাড়ি ফিরে। মাহিয়ার মা জানিয়েছেন, খাওয়া দাওয়া শেষে শিশু মাহিয়া বাড়ির আঙ্গিনায় খেলা করতে যায়। দুপুর ২ টা পর্যন্ত বাড়িতে না আসায় খুঁজাখুঁজি শুরু করে মা। কিন্তু মেয়ের খোঁজ কোথাও পাওয়া যায়নি। পরে এলাকায় মেয়ের খুঁজে মাইকিং করে। এরপরেও মেয়ের সন্ধ্যান না পেয়ে মাহিয়ার বাবা আয়াত উল্লাহ মহেশখালী থানায় মেয়ে নিখোঁজের জিডি করেন।

যেভাবে বুঝতে পারেন মাহিয়া অপহরনের শিকার হয়েছেঃ
থানায় জিডি দায়েরের পরের দিন ১লা নভেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মাহিয়ার বাবা আয়াত উল্লাহর মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে পুরুষ কন্ঠে একজন মাহিয়ার বাবার নিকট মাহিয়াকে ফিরে পেতে ৫লাখ টাকা মুক্তিপন দাবী করে। টাকা না দিলে মেয়েকে মেরে ফেলার হুমকি দেয় ওই ব্যক্তি। আয়াত উল্লাহ মেয়ে মাহিয়ার সাথে কথা বলতে চাইলে ওই ব্যক্তি ফোনটি কেটে দেন। এরপর থেকে ওই ফোন নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। এই ঘটনার পর আয়াত উল্লাহ অজ্ঞাতনামা আসামীদের বিরুদ্ধে ৩ ডিসেম্বর অপহরণ মামলা দায়ের করেন।

অজ্ঞাত পরিচয়ে উদ্ধার হওয়া লাশের পরিচয় সনাক্তঃ
পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া নদীর পাশে করিয়ার দিঘী জাহিদ চৌধুরীর চিংড়ি  ঘেরে সকালে একটি মরদেহ দেখতে পান স্থানীয়রা। তারা সাথে সাথে পেকুয়া থানায় খবর দেন। পেকুয়া থানার পুলিশ সে মরদেহটি উদ্ধার করে। এসময় মরদেহটি ফুলে গিয়েছিল এবং লাশে পঁচন ধরে। অজ্ঞাত মরদেহটি উদ্ধারের ঘটনাটি বিভিন্ন মাধ্যমে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন মাহিয়ার বাবা আয়াত উল্লাহ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহটি তারই কন্যা মাহিয়ার বলে সনাক্ত করে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওমর হায়দার।

যেভাবে খুনি ধরা পড়েঃ
অপহরণ মামলা দায়েরের পর মহেশখালী থানার পুলিশের একটি টীম মুক্তিপন চাওয়া মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে তদন্তে মাঠে নামে। প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণকারীদের অবস্থান উদঘাটনের চেষ্টা করে পুলিশের টীমটি। এরই মধ্যে মাহিয়ার লাশ উদ্ধার হয় পার্শ্ববর্তী উপজেলা পেকুয়া থেকে। অপহরন চক্রটি মহেশখালীর নাকি পেকুয়ার কিংবা অন্য জায়গার সে বিষয়ে নানান প্রশ্ন সৃষ্টি হয় পুলিশের। পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিক ভাবে জানতে পারে ওই নাম্বারটি মাতারবাড়িতে এক্টিভ আছে। যে ফোনে সীম ব্যবহার করে মুক্তিপনের জন্য ফোন দিয়েছিল সেই ফোনে ব্যবহৃত অন্য একটি নাম্বার পুলিশের হাতে আসে। সেই নাম্বারের সূত্র ধরে এবং খুনের বিভিন্ন ক্লু নিয়ে পুলিশ গোপনে মাতারবাড়িতে অবস্থান করে। পরে পুলিশ মাতারবাড়ির সাইরার ডেইল থেকে সোলেমান (২৫) নামের এক যুবক ও তার স্ত্রীকে আটক করে।

খুনের রহস্য যেভাবে উদঘাটন হয়ঃ
আটককৃত যুবক সোলেমান জিজ্ঞাসাবাদে খুনের সাথে তার জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। এই যুবক ও তার স্ত্রী গত ১৩ দিন আগে মাহিয়াদের বাড়িতে বাসা ভাড়া নেয়। সেই সুবাধে মাহিয়াদের সাথে তাদের সখ্যতা গড়ে উঠে। ঘাতক সোলেমান জানায়, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে শিশু মাহিয়া যখন খেলতে বের হয় তখন তাকে চিপস, বিস্কিট ও জুস খেতে দেয় সোলেমান। তারপর কৌশলে মাহিয়াকে বাড়ির কক্ষে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে সেখানে মাহিয়াকে সে ধর্ষণ করে, যখন মাহিয়া চিৎকার দেয়ার চেষ্টা করে তখন দুই হাত দিয়ে মুখ ও গলা চেপে ধরে খুনি সোলেমান। এরই মধ্যে শিশু মাহিয়ার দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ে, তখন খুনি মাহিয়াকে তার বাড়িতে থাকা একটি লাগেজে ভরে লাশ গোপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেইমতে লাগেজটি টমটমে তুলে নদীর পাড়ে নিয়ে আসে। সেখান থেকে নৌকায় করে নদীর পাশের প্রজেক্টে যেখানে পরে লাশ পাওয়া যায় সেখানে ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।

কে এই খুনী সোলেমানঃ
শিশু মাহিয়া হত্যাকান্ডে জড়িত খুনির পুরো নাম মোহাম্মদ সোলেমান (২৫)। তার পিতার নাম মৃত ছৈয়দ করিম। তার বাড়ি টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডস্থ চাকমারকুল গ্রামে। খুনী সোলেমান স্বীকারোক্তিতে জানান, শিশু মাহিয়াকে ছাড়াও চার বছর আগে তার কথিত প্রেমিক আসমা আকতার নামের এক রোহিঙ্গা তরুনীকে গলা কেটে হত্যা করেছিল। ওই হত্যার পর সে চট্টগ্রামে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেখানে বিয়ে করে মাতারবাড়ি এলাকার শাহিদা আকতার নামের এক মেয়েকে। গত চার মাস আগে চট্টগ্রাম থেকে মাতারবাড়িস্থ তার শ্বশুরবাড়িতে চলে আসে। সেখানে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সাথে বনিবনা না হওয়ায় মাহিয়ার বাবা আয়াত উল্লাহর বাড়িতে ভাড়া বাসা নেয়। এই ব্যক্তি চরম ভাবে ইয়াবা আসক্ত ছিলো বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানাচ্ছে।

পুলিশ কি বলছেঃ
তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় খুনের সাথে জড়িত সোলেমানকে আটকের পর পুলিশের কাছে সে খুনের বিষয়টি স্বীকার করে৷ মহেশখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রনব চৌধুরী জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সোলেমান স্বীকার করে সে একাই শিশু মাহিয়াকে ধর্ষণ করে। তারপর খুনের পর লাশ গুমের চেষ্টা করেছে। এই ঘটনায় তার স্ত্রী জড়িত নয়। সোলেমানকে আটক করার পর তাকে নিয়ে পুলিশের একটি টীম রাতভর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। ঘটনার বিষয়ে তাকে আরো জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সচেতন মানুষের অভিমত কিঃ
মাহিয়া খুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রাম শহরে ভাড়াটিয়ার হাতে নির্মম ভাবে খুন হন শিশু আয়াত। কয়েকদিনের ব্যবধানে সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মহেশখালীতে। এখানেও ভাড়াটিয়ার হাতে খুন হয়েছে স্কুল ছাত্রী মাহিয়া। এখন শিশুরা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসব খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া দরকার। আর নাগরিকদের মাঝে শিশু নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন বৃদ্ধি করার জন্য পরিকল্পনা হাতে নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান তারা।