Advertisement


মানবিকতা দিয়ে জয় করি এই মহামারীকে

বর্তমান বিশ্বে এক আতঙ্কের নাম করোনা ভাইরাস। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারীতে রূদ্ধ  হয়ে পড়েছে সারা বিশ্ব। প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। অসহায় করে দিয়েছে সারাবিশ্বকে। বন্ধ হয়ে গেছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও ব্যবসা। খুলে দিয়েছে অসংখ্য স্বার্থান্বেষী মহলের আসল চেহারা। করোনার এই ভয়াবহ দূর্যোগে কিছু মানুষের অমানবিক আচরণে হতাশ গোটা জাতি। বিশেষ করে লোভী ব্যবসায়ীদের আচরণ ও স্হানীয় প্রভাবশালী কিছু মানুষের অমানবিকতায় হতাশ করেছে গোটা জাতিকে।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বর্তমানে একটি বৈশ্বিক সমস্যা। কোন দেশের মানুষ ঝুঁকি মুক্ত নন। অদৃশ্য এ করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানানোর অন্যতম ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার এর হিসাব অনুযায়ী ইতিমধ্যে সারা পৃথিবীতে ২১৩টি দেশে ১কোটির বেশি মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছেন। আর কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মৃত‌্যুবরণ করেছে ৫ লাখের বেশি মানুষ। বাংলাদেশও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকহারে। প্রতিদিন হুহু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। বাড়ছে মৃতের সংখ্যাও। থমকে পড়ছে গোটা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। চরম দুর্ভোগে দিন পার করতেছে দেশের নিম্নভিত্ত মানুষ গুলো। করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত জনজীবন। সবখানে এখন রূদ্ধতা। কর্মহীন হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে এসব অসহায় মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে অনেকে। কেউ কেউ খাদ্য বিতরণ করেছে কর্মহীন অসহায় মানুষের মধ্যে। কোথাও বসেছে বিনামূল্যে ঔষধ বিতরণের জন্য 'মানবতার বাজার '। কোথাও মাত্র এক টাকায় খাদ্য পন্য কিনতে পারছেন অনেক গরিব মানুষ। কোথাও অসহায়দের সহায় হয়েছে 'মানবতার ঘর'। তারপরও কিছু মানুষের এখনো বোধোদয় হয়নি। এসব মানুষগুলো অন্যের সাহায্যে ত এগিয়ে আসেনি বরং চরম অমানবিকতা দেখাচ্ছে। কতটা অমানবিক হচ্ছে তা দেশের সংবাদপত্র গুলোর শিরোনাম দেখালে বুঝা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নামকরা সংবাদমাধ্যম গুলোর শিরোনামের কয়েকটি ছিল 'বাবা দিবসে করোনা আক্রান্ত বাবাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিল সন্তানেরা ', 'দিনভর অচেতন হয়ে পড়ে থেকেও করোনার ভয়ে এগিয়ে আসে নি কেউ', 'সিলেট ৪ হাসপাতাল ঘুরে ব্যবসায়ীর মৃত্যু ',
'৬ হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সেই রোগির মৃত্যু', 'পাঁচ হাসপাতাল ঘুরে ছেলের লাশ নিয়ে ফিরলেন বাবা', 'করোনা ভয়ে লাশ উঠানে পরে ছিল ১০ দিন', 'করোনা লক্ষণ তাই এমন দাফন', 'করোনা উপসর্গে মৃতব্যক্তির দাফন করায় ইমামের চাকরিচ্যুত! '।

এই জাতীয় সংবাদ সমূহ মানুষকে ব্যথিত করছে প্রতিনিয়ত। একজন মানুষের শ্বাসকষ্ট থাকতেই পারে। তার মানে এই নই যে সে করোনা রোগী। শুধু সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বাবাকে রাস্তায় ফেলে চলে যাবেন, করোনা রোগী সন্দেহ অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকা মানুষকে এড়িয়ে যাবেন, এসব শুধু অন্যায় নাই বরং চরম অমানবিকতা। এই মানুষ গুলোর জায়গায় একবার নিজে কে চিন্তা করেন তো। আপনারা ছেলেরা যদি আপনাকে অসুস্থ অবস্থা রাস্তায় ফেলে চলে যায় তখন কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই আপনি কল্পনাও করতে পারছেন না। আপনি একজন অচেতন হয়ে পড়ে থাকা মানুষের কাছে যাননি। আপনি যদি রাস্তায় অচেতন হয়ে পড়ে থাকেন কে আপনার কাছে আসবে?

একজন অসুস্থ মানুষ তৎক্ষনাৎ চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। কিন্তু হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরে অনেক জটিল ও গুরুতর রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে না।  করোনা বহির্ভূত রোগী হ‌য়েও বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করতেছে অনেকে। মেনে নিলাম বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে, তাই বলে অন্য গুরুতর অবস্থার রোগীকে চিকিৎসক চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানাবেন? এটি চিকিৎসা স্বাস্থ্যের নিয়মনীতি - বহির্ভূত বটে, সেই সঙ্গে মানবিক রীতিনীতি-বহির্ভূতও। একবার সেই মানুষটির কথা চিন্তা করেন তো যে তার ছেলেকে নিয়ে  হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে ছেলের লাশ কাঁদে নিয়ে বাসায় ফিরতে হলো। সেই ভাইটির কথা চিন্তা করেন তো যাকে নিয়ে তারা আত্মীয় স্বজনরা ৬টি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুবরণ করল।

করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের ভয়ের কোন অন্ত নেই। কিন্তু যে মানুষটি করোনায় আক্রান্ত তার দ্বারা অন্য কেউ সংক্রামিত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, সেই মানুষটির বাড়িতে কোন বিচারে এলাকার প্রভাবশালীর নেতৃত্বে ইট পাটকেল মারতে পরেন? যারা আজ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে অন্যের বাড়িতে হামলা করতেছে, তাদের একবারও মনে হল না এই ভাইরাসের দ্বারা আমিও তো আক্রান্ত হতে পারি! তখন কি হবে আমার? করোনা ভাইরাস ত আর বেছে বেছে ধরে না। যার প্রমাণ আমার ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছি। করোনার থাবায় মৃত্যুবরণ করেছে দেশের অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক সহ অনেকে। আপনারা কি মানুষ! মানুষ কি পরিমাণ অমানবিক হতে পারলে করোনা উপসর্গে মৃত ব্যাক্তির লাশ দাফন করায় ইমামকে চাকরিচ্যুত করতে পারে! তাদের কি একবারও মনে হলো না এই মৃত্যুর মিছিলে আমিও তো চলে যেতে পারি। তখন কে আমার দাফন করবে?

এই মহামারীর আগে ডাক্তারদের বাড়ি ভাড়া দিতে যে সব বাড়ির মালিকরা এত আগ্রহ দেখিয়েছেন, কোথায় চলে গেছে এখন আপনার এত আগ্রহ! কোন বিবেকে করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা দিচ্ছে বলে ডাক্তারদের বাসা ছেড়ে দিতে বলতে পারেন? যে সব বাড়ির মালিক ডাক্তারদের বাসা ছেড়ে দিতে প্রতিনিয়ত ছাপ দিচ্ছে, তাদের কি একবারও মনে হল না আমিও ত এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি! তখন কে আমাকে চিকিৎসা দিবে?

এই মহা দুর্যোগে পণ্যের দাম বাড়াতেই পারে এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু যে পন্যটি তৈরি করতে এই মহামারীর কারণে কোন বাড়তি খরচ হচ্ছে না, সেই পণ্যের দাম কোন বিচারে দিন দিন বাড়িয়ে দিতে পারে? যারা দিনে দিনে অধিক মুনাফার লোভে পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে দিচ্ছে, তাদের একবারও মনে হল না এই ভাইরাসের দ্বারা আমিও মরে যেতে পারি! তখন কি কাজে আসবে এই অধিক মুনাফার অর্থ? আপনার কি সেই মানুষ গুলোর কথা একবারও চিন্তা করেন নি যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সেই মানুষ গুলো কিভাবে দিন পার করছে এই মহামারীতে
একজন মানুষ মৃত্যু বরণ করলে তার দাফন কাফনের ব্যবস্থা করা প্রতিবেশী ও আত্মীয় স্বজনের নৈতিক দায়িত্ব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া তথ্য অনুযায়ী মৃত্যুর তিন ঘন্টা পর মৃত ব্যাক্তি থেকে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তারপরও কোন বিচারে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যাক্তির মরদেহ করব দিতে এলাকার মানুষ বাদা দেয়! তারপরও কেন করোনা আক্রান্ত মৃত ব্যাক্তির লাশ বাসার সামনে ১০দিন পরে থাকা লাগে? এই মহামারীতে কে বেঁচে থাকবে কে মরে যাবে, তা আমরা কেউ জানি না । যারা আজ মৃত ব্যাক্তির লাশ দাফন করতে ১০ দিনেও এগিয়ে আসল না, তাদের কি একবারও মনে হলো না এই মহামারীতে আমিও তো মরে যেতে পারি! তখন কে এগিয়ে আসবে আমার লাশ দাফন করতে? আপনার মৃত্যুর পর যদি আপনারই স্বজনরা এভাবে বলে যে আপনাকে কবর দেওয়া যাবে না। তখন কেমন লাগবে আপনার স্ত্রী-সন্তানের?

আসুন আমরা মানবিকতা দিয়ে এই মহামারীকে জয় করি। কর্মহীন অসহায় মানুষকে খাদ্য দিয়ে,অসুস্থ রোগী কে সেবা দিয়ে, মৃত ব্যাক্তিকে যথাযোগ্য মর্যাদায় দাফন কাফনের ব্যাবস্থা করে। 

শাহ জাহান আল সাদাফ 
শিক্ষার্থী আইন বিভাগ 
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়